নতুন পাঠ্যক্রম: অবাস্তব পরিকল্পনার দলিল - দৈনিকশিক্ষা

নতুন পাঠ্যক্রম: অবাস্তব পরিকল্পনার দলিল

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষার পাঠ্যক্রম তৈরি একটি বিশেষজ্ঞ–কাজ। বিস্তর অধ্যয়ন, গবেষণা ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ শিক্ষাবিজ্ঞানীরাই পারেন কাজটি যথাযথভাবে সম্পাদন করতে। যেকোনো রকম অযাচিত হস্তক্ষেপ তা ভন্ডুল করে দিতে পারে। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে কত আহাম্মকি এ দেশে চলছে, তার কিনার করা কঠিন। এ বিষয়ে ডাক পড়ে তাঁদের, যাঁরা শিক্ষাবিজ্ঞানের দরজা মাড়াননি কখনো। কমিটিগুলোয় পদাধিকারীদের আধিক্য ও প্রতাপ এত বেশি যে শিক্ষাবিজ্ঞানী যাঁরা থাকেন, তাঁদের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। আর মাথার ওপর ছড়ি ঘোরান আমলারা। পাঠ্যক্রমকে বলা হয় শিক্ষার মস্তিষ্ক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মাণের চাবিকাঠি। তাই সেটি প্রণয়নে দূরদর্শী শিক্ষাবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেওয়া ও তা বাস্তবায়নে তাঁদেরই দায়িত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু এ জাতির দুর্ভাগ্য, এই বিষয়ে শিক্ষাবিজ্ঞানীরা চিরকালই ব্রাত্য বলে বিবেচিত। সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, শিক্ষার পথরেখা রচনার দায়িত্ব যোগ্যতরদেরই করবার কথা। কিন্তু অনেক সময় সবজান্তা কিছু আমলা, দেশি-বিদেশি মতলববাজ পরামর্শক, দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার আর অবিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরাও বাংলাদেশের শিক্ষার এই পথরেখা রচনার দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। শুধু যে কারিকুলাম রচনায় এ অনিয়ম, তা–ই নয়, স্কুল-কলেজ পরিদর্শন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নেও। উদার, স্বাধীনচেতা, সাহসী, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ কিংবা বিজ্ঞানীদের কদর কম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষা বোর্ডের স্কুল বা কলেজ পরিদর্শক, মাউশির প্রশিক্ষণ পরিচালক, নায়েম বা এইচএসটিটিআইয়ের প্রশিক্ষক, এমনকি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর শিক্ষক, অধ্যক্ষের পদ এখন অশিক্ষাবিজ্ঞানীদের দখলে। এনসিটিবি, মাউশির সর্বত্র এখন তাঁদেরই রমরমা। শিক্ষাবিজ্ঞানের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্কহীন এসব প্রশাসক দিয়ে আর যা–ই হোক, কারিকুলাম প্রণয়ন, বাস্তবায়ন প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা পরিদর্শনের মতো বিশেষজ্ঞ–কাজ করানো অসম্ভব। কিন্তু আমরা অসম্ভবের পায়ে ভর দিয়ে হিমালয় উল্লঙ্ঘনের স্বপ্ন দেখি। তারই প্রতিফলন স্পষ্ট প্রস্তাবিত কারিকুলামের পরতে পরতে।

জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে ২০১৮ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক এবং চলমান উচ্চমাধ্যমিক স্তর বিলুপ্ত করে নবম-দ্বাদশ শ্রেণি মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করার কথা ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেমন সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই, তেমনি তার কোনো প্রতিফলনও নেই প্রস্তাবিত কারিকুলামে। এনসিটিবির কর্তৃত্ব যেহেতু উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত, তাই এ পরিকল্পনায় পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক সমাপনী, অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা, দশম শ্রেণিতে মাধ্যমিক এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সেই বহু পুরোনো নিয়মই বহাল রাখা হচ্ছে। শুধু ফারাক দেখা যাচ্ছে এক জায়গায়—নবম-দশম শ্রেণি হবে মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষার মতো বিভাজনমুক্ত একমুখী শিক্ষা দিয়ে। উচ্চমাধ্যমিক যথারীতি মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষায় বিভাজিত থাকবে। সেটা নাকি পেশাগত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যেই। কিন্তু সেখানেও গোঁজামিলের অন্ত নেই।

জাতীয় শিক্ষানীতি যেমন কথামালায় টইটম্বুর এক দলিল, তেমনি প্রস্তাবিত কারিকুলামের উদ্দেশ্য বর্ণনায় অভিধান ঘেঁটে ভালো ভালো কথায় ঠাসা। একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। মৌলিক ১০টি দক্ষতা ‘চিন্তা, সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যার সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সহযোগিতা, যোগাযোগ, বিশ্বনাগরিকত্ব, জীবিকায়ন, স্বব্যবস্থাপনা ও মৌলিক দক্ষতা অর্জন কারিকুলামের লক্ষ্য। এ জন্য ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সমাজ ও বিশ্বনাগরিকত্ব, জীবন ও জীবিকা, পরিবেশ ও জলবায়ু, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি—এই ১০ বিষয় শ্রেণি অনুযায়ী শেখানো হবে’ (প্রথম আলো, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯)। কিন্তু জীবিকায়ন, স্বব্যবস্থাপনার মতো কোন কোন বিষয় কীভাবে পড়ানো হবে? বেশ কিছুকাল যাবৎ একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা ছিল যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। কিন্তু এই দলিলে তার কোনো উল্লেখ নেই। তাহলে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাদানের লক্ষ্য অর্জিত হবে কীভাবে? তবে কি আবারও তত্ত্ব ও সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষাই নবীন শিক্ষার্থীদের ভবিতব্য?

এবার দেখা যাক বিভাজন রহিত মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের ধরনটাই। যেখান বিভাগই থাকবে না, সেখানে গুচ্ছের প্রশ্ন কেন? তাও আবার চার চারটি গুচ্ছ? যদি এটা ধর নিই যে ‘ক’ গুচ্ছ শিক্ষার মৌলিক বিষয় ভাষা ও গণিত শেখানোর জন্য করা হয়েছে আর ‘খ’ গুচ্ছ (বিজ্ঞান ও সমাজ পাঠ) করা হয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান ও সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে, তাহলে বলতে হবে ‘ক’ ও ‘খ’ গুচ্ছ মিলে একটাই গুচ্ছ হতে পারত, যদিও তা বাহুল্যই।

কিন্তু ‘গ’ ও ‘ঘ’ গুচ্ছ কেন করা হচ্ছে? ‘গ’ গুচ্ছের বিষয়গুলো তথ্যপ্রযুক্তি, চারু ও কারুকলা, শরীরচর্চা ও খেলাধুলা, ধর্ম ও নৈতিকতা, কৃষি ও গার্হস্থ্য, নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। বলা হচ্ছে, এ বিষয়গুলো শিক্ষার্থীকে পড়তে হবে, কিন্তু পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না, কেবল বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে। অন্যদিকে, ‘ঘ’ গুচ্ছে প্রকৌশল প্রযুক্তি (বিদ্যুৎ, যন্ত্র, কাঠ, ধাতু ইত্যাদি ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রয়োগ করা হতে পারে)। এগুলোও স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়নের কথা প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে থামেনি প্রস্তাবিত কারিকুলাম। শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কর্ম ও পেশা নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নবম ও দশম শ্রেণিতে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, হিসাব, বিপণন, ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি বিষয়গুলো থেকে যেকোনো দুটি বিষয় পছন্দ করে নেওয়ার সুযোগ থাকবে শিক্ষার্থীর। এমনকি, ইচ্ছা করলে শিক্ষার্থীরা ‘ঘ’ গুচ্ছে আরও একটি বিষয় নিতে পারবে। এর ফলে আসল উদ্দেশ্যই ভন্ডুল হয়ে গেছে; শিক্ষার্থীদের ওপর বেড়ে যাবে বইয়ের বোঝা এবং এক বিশাল বৈষম্য তৈরি হবে তাদের মধ্যে।

এ বিষয়ে ড. আবদুস সাত্তার মোল্লার পরামর্শ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, শাখাবিহীন মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে এমনভাবে বিষয় নির্বাচন করতে হবে, যাতে উচ্চশিক্ষার স্তরে যেকোনো শাখা ও বিষয় পড়ার মজবুত ভিত তৈরি হয়। এর জন্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত (একক), ধর্ম এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির মতো ‘কোর’ বিষয়গুলো ছাড়াও বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা—প্রতিটি ধারার এক/একাধিক বিষয়ের সমাহার ঘটানো প্রয়োজন। বিজ্ঞানের ভিত মজবুত করার জন্য ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান নামে দুটি পত্রের ব্যবস্থা থাকতে পারে। পরিবেশ শিক্ষার মূল বিষয়গুলো ভৌত ও জীব উভয় বিজ্ঞানে এবং শারীরিক শিক্ষার জীব বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো জীববিজ্ঞানে অন্তর্ভুক্ত করলে পরিবেশ শিক্ষা বা শারীরিক শিক্ষার কোনোটার জন্যই পৃথক পাঠ্য বিষয় দরকার হবে না। বিশ্বনাগরিকত্ব ও উচ্চতর মানববিদ্যার ভিত রচনার জন্য বিশ্বসভ্যতার (বাংলাদেশসহ) ইতিহাসসংবলিত (যাতে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ভিত তৈরি হয়) একটি পত্র এবং পৌরনীতি ও অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো নিয়ে আরেকটি পত্র। ব্যবসায় শিক্ষার ভিত তৈরির জন্য হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে যে পত্রটি পাঠ্য হতে পারে, তাকে কৃষিশিক্ষা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ও নতুন পাঠ্য প্রকৌশল শিক্ষার মতো বৃত্তিমূলক বিষয়ের মধ্যে একটির অপশন থাকলে পত্রের মোট সংখ্যা (ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া) ১২–র মধ্যে সীমিত রাখা যাবে। উচ্চমাধ্যমিক উপস্তরের পাঠ্য বিষয় বর্তমানের মতোই থাকতে পারে।

লেখক: আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035707950592041