নতুন বইয়ের গন্ধ - দৈনিকশিক্ষা

নতুন বইয়ের গন্ধ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা এবং একুশের পথ ধরে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। সেই ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত সালাম, বরকত, শফিক, রফিক, জব্বারের রক্তস্নাত ভাষার মাস শুরু হলো। সেই সঙ্গে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, মাতৃভাষা বাংলাকে কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু বুকের তাজা রক্তে বাংলার দামাল ছেলেরা নিজের ভাষাকে রক্ষা করেছে। উর্দু নয়, বাঙালির মাতৃভাষা বাংলায়ই তারা কথা বলে, লেখে, স্বপ্ন দেখে। এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ফলে সম্ভব হয়েছে ভাষাভিত্তিক একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের।

ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা নতুন করে ভাষা চেতনায় শাণিত হই। কিন্তু সারা বছর ধরে বাংলার চর্চা আসলে কতটা চলে, এই আত্মোপলব্ধি অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যে মর্যাদা প্রাপ্য ছিল সেটি কি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে? তাহলে মিথ্যা হবে শহীদের রক্তদান? দুঃখজনক হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রীয় ও দাপ্তরিক অনেক কাজও হয় ইংরেজিতে। চারদিকে তাকালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে শুরু করে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সব কিছু ইংরেজিতে। প্রশাসনিক কাজ তো বটেই, উচ্চ আদালতের ভাষায়ও ইংরেজির দাপট। নিতান্তই নাম স্বাক্ষর জানা সাধারণ একজন মোবাইল ফোনের সিমের ক্রেতাকেও ইংরেজি ভাষার একটি দুর্বোধ্য ফরম পূরণ করতে হয়। এটা আমাদের মানসিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।

হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলা সমৃদ্ধ একটি ভাষা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের মতো লেখক সৃষ্টি হয়েছে এই ভাষায়ই। কিন্তু সেই ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী সময়ে তেমন  কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে? সময়ের অভিঘাতে পাল্টে যাচ্ছে সব কিছু। প্রযুক্তিনির্ভর একবিংশ শতাব্দীতে তরুণ প্রজন্মও বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীন। অন্য ভাষা শেখায় কোনো দোষ নেই। রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়ে বলতে হয়—‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, পরে ইংরেজি শেখার পত্তন’। মাতৃভাষা ভালো করে না জানলে কোনো ভাষায়ই দক্ষতা অর্জন করা যায় না। এবারের ফেব্রুয়ারিতে আমাদের শপথ হোক মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার।

একুশের আরেক অর্জন বইমেলা। আর বইমেলা মানে পুরো মাসজুড়েই সৃজনশীল বই প্রকাশনার মৌসুম। লেখক, প্রকাশক, পাঠক সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন এই বইমেলার জন্য। পরিসর, ব্যাপ্তি ও আবেগের দিক থেকে এই বইমেলা হয়ে উঠেছে আমাদের প্রাণের উৎসব। বাঙালির কোনো সাংস্কৃতিক উৎসব নেই। সেদিক থেকে বাঙালির প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবও এই বইমেলা। বইমেলা জড়িত বাঙালির চেতনা এবং আবেগের সঙ্গে। যে একুশের চেতনার পথ ধরেই এসেছে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার এবং এরই পথ ধরে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা।

বাঙালির যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস ঐতিহ্য তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়েই। বইমেলা সাংস্কৃতিক জাগরণে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদার চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে একুশে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে। এখানে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা-পাঠকেরই সমাগম হয় না, মেলা পরিণত হয় লেখক-প্রকাশক-পাঠক, দর্শকসহ বয়স শ্রেণি-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলায়। সৃজনশীল প্রকাশকরা হাজারো বইয়ের পসরা নিয়ে হাজির হন বইমেলায়। মেলায় আগত দর্শক সমাগম নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে সারা দেশের অগণিত গ্রন্থ পিপাসুর নতুন বই হাতে পাওয়ার বিপুল আকাঙ্ক্ষাকে। বইমেলায় আসেন লেখকেরা, বিশেষত তরুণ-তরুণীরা, কিশোর-কিশোরীরা, ছাত্র-ছাত্রীরা, আর আসেন মধ্যবিত্ত। যারাই মেলার প্রধান ক্রেতা। জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত লেখকের বই ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত আমলা, প্রবাসী বাঙালি কিংবা নবীন লেখকের কাঁপা হাতের প্রথম লেখাটিও ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে। একুশের মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। এটা প্রকাশনা শিল্প, লেখক পাঠক কারো জন্যই শুভকর নয়। সারা বছর ধরে বইয়ের প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে এই মেলাকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।

পেশাদারি প্রকাশক ছাড়াও অপেশাদারি প্রকাশকরাও মেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ করেন। এর ভালোমন্দ দুই দিকই রয়েছে। অনেকে লেখক হওয়ার বাসনায় গাঁটের পয়সা খরচ করে নিজ উদ্যোগে বই বের করেন। এতে মেলায় বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও সে হারে মান বাড়ছে না। যেনতেনভাবে নতুন বই মেলায় আনার প্রবণতার ফলে মানহীন বই, ভুল বানান, তথ্য ও মুদ্রণত্রুটিযুক্ত বইয়ে বাজার ভরে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে তা প্রকাশনা শিল্প, লেখক, ক্রেতা, পাঠক সবার জন্যই ক্ষতিকর। এ জন্য সারা বছরই বইয়ের প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে মেলার সময়ে বই প্রকাশের বাড়তি চাপ থেকে লেখক, প্রকাশক সবাই মুক্ত থাকতে পারবেন। তখন প্রকাশনার প্রতি যথাযথ মনোযোগ এবং যত্নশীল হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হবে।

আর একটি বিষয় হচ্ছে বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয় সে তুলনায় বিক্রি হয় না। যদিও প্রতিবছর মেলায় প্রায় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয় বলে প্রকাশকরা বলে থাকেন।

‘মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা যে মেলার বীজ বপন করেছিলেন সেটি ফুলে-ফলে এখন এক বিরাট মহীরুহ। আজ এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ও জাতিগত আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত এক জাতীয় মেলা। এর রূপ, রং, চরিত্র আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার সমার্থক। কেননা বইমেলা প্রাঙ্গণে যাঁরা সমবেত হন তাঁরা শুধু বই কিনতেই আসেন না। আসেন সামাজিক দায় মেটানোর বোধ থেকেও।

প্রতিবছরই ঘুরে-ফিরে আসে অমর একুশে বইমেলা। একুশের চেতনাসমৃদ্ধ মেলাকে কিভাবে আরো সম্প্রসারণ করা যায়, এর শ্রীবৃদ্ধি করা যায়—এ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। এর কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সময়ের অভিঘাতে সব কিছু পাল্টাচ্ছে। মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও পাল্টাচ্ছে। যে কারণে এর সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বইমেলার চেতনা, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে বইমেলা যেন আরো বেশি অবদান রাখতে পারে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ ২০০৪ সালে এই বইমেলা থেকে ফেরার পথেই একদল ধর্মান্ধ আততায়ীর হাতে মারাত্মক আহত হন। চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন কিছুদিন পরই। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হতেই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে আহত করে। এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এখনো ক্রিয়াশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিতে চাচ্ছে তারা। সৃজনশীল, প্রগতিবাদী, অসাম্প্রদায়িক মানুষরা এদের পরম শত্রু। এ কারণেই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বইমেলা হতে পারে এক বিরাট প্রতিবাদ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায়ও বইমেলার অবদান কম নয়।

ঝলমলে তারুণ্যই তো পাল্টে দিতে পারে সব কিছু। ইন্টারনেট, ফেসবুক আর মুঠোফোনের মায়াজালের মধ্যেও নানা রঙের আনকোরা প্রচ্ছদে ছাপা নতুন বইয়ের গন্ধে কি উদ্বেল হবে না তারুণ্য? সার্থক করবে না মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিংবা শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে? 

ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.011035919189453