গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিরোজপুর জেলায় একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত এসেছে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। এখানে বলা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু একটি গুণবাচক ধারণা ও প্রতিষ্ঠান। মানুষের জীবনের উৎকর্ষ সাধন এবং 'মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ' গড়ার জন্য জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চাই এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু সৃষ্টিশীল উৎপাদনের পূর্বশর্ত হলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ছাড়া কোনো সৃজন হতে পারে না। স্বাধীনতাহীনতায় প্রাপ্ত জ্ঞান বড়জোর 'দক্ষ শ্রমিক' উৎপাদন করতে সক্ষম; জ্ঞানী নয়। স্বাধীনতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমূর্ত ধারণার অংশ। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একটি বিমূর্ত প্রতিষ্ঠান, যাকে জড়িয়ে থাকে মূর্ত নানা উপকরণ। যেমন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসন, ভৌগোলিক এলাকা, আড়াআড়ি বা খাড়াখাড়ি বিস্তৃত ভৌত অবকাঠামো ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ের গভীরে অদৃশ্য জ্যার মতো একটি আত্মা থাকে। যাকে পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে চিহ্নিত করা না গেলেও সংবেদনশীল চৈতন্য দিয়ে বেশ অনুভব করা যায়। ওই আত্মাটিই সমস্ত জাহিরি উপকরণের ভেতর দিয়ে একটি সুললিত সুর তৈরি করে গড়ে তোলে বিশ্ববিদ্যালয়।
সাধারণত দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যায়- পাঠদানকেন্দ্রিক ও গবেষণাভিত্তিক। স্নাতক স্তরে প্রধানত আন্তঃশাস্ত্রীয় পাঠদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণাকে জোর দেওয়া। আন্তঃশাস্ত্রীয় পাঠদান কেন জরুরি? আন্তনিও গ্রামসি, নোয়াম চমস্কি, টমাস কুন, ফায়ারাবেনসহ অগণন তাত্ত্বিক মনে করেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে হয় না। বরং এর বিকাশ সংশ্নিষ্ট জ্ঞানের মধ্যকার বিরাজমান স্ববিরোধিতা চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আসে। শুধু প্রায়োগিক বা কারিগরি দিক গুরুত্ব পেলে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় শিক্ষার বৈচিত্র্যময় সব বিষয়ের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক, মানবিক ও কলাবিদ্যার বিষয়গুলো থাকতে হবে। উচ্চতর জ্ঞান অবশ্যই আন্তঃশাস্ত্রীয় হতে হবে।
আন্তঃশাস্ত্রীয় ও গবেষণামূলক পাঠদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমূর্ত সত্তাকে কিন্তু আশ্রয় নিতে হয় বিস্তৃত আর নিবিড় কোনো প্রাকৃতিক পরিসরে। চাপমুক্ত এ রকম পরিসরে চৈতন্য তীব্রতর বিকশিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশ কাঠামো স্বাস্থ্যকর ও আধ্যাত্মিক হয়ে উঠলে শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনায় আরও বোধগত উন্মেষ ঘটে। আচরণে ইতিবাচকতা নির্মিত হয়; সামাজিকতার আঙ্গিক ও বহুমাত্রিকতার বিবেচনা বিকশিত হয়; যোগাযোগ দক্ষতা হয়ে ওঠে পরিশীলিত; কাঙ্ক্ষিত আবেগের স্ম্ফুরণ ঘটে এবং মস্তিস্কের মটর-নিউরন বেশি সক্রিয় হয়।
সবুজ ও নিবিড় জলাশয়ের সম্মিলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের গহনতাই কাম্য। পাখির কলতান, জ্যোৎস্নার প্রাচুর্য এবং সব রকম প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য থাকতে হয় সেখানে। আর এসবের জন্য প্রয়োজন বিশাল ভৌগোলিক পরিসর। সেখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত রক্ষার আন্তরিকতা থাকতে হবে শুরু থেকেই। নিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোপলিটান পরিসর পঙ্গু হতে পারে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়াস হলেন উপাচার্য। উপাচার্য যদি হন সৎ মানুষ, প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ও জনবুদ্ধিজীবী, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্থক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
পরিশেষে বলতে চাই, পিরোজপুরের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সুবিচার করুক। আন্তঃশাস্ত্রীয় মুক্ত জ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক। দেশকে এনে দিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে বৈশ্বিক পরিচিতি আর মানুষের জন্য নিয়ে আসুক ৭ মার্চের প্রস্তাবিত সেই কাঙ্ক্ষিত 'মুক্তি'।
লেখক: কাজী মসিউর রহমান, শিক্ষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।