শিক্ষায় আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের চেয়ে উচ্চশিক্ষায় বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে। কারণ আমাদের দেশের সরকারি খাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এরই মধ্যে ৪০ ছাড়িয়েছে। বেসরকারি খাতে তো তা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে; যদিও বেসরকারি খাতের দু-একটি বাদে বাকিগুলো সনদসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং কেন্দ্রের মতো ভাড়া বাড়িতে বছরের পর বছর চালাচ্ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম, যা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষণের সঙ্গে কোনো ক্রমেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নিজস্ব চত্বরে যাওয়ার ব্যাপারে সরকার সময় বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানেনি। আবার এগুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সবাই বাণিজ্যিকভাবেই এগুলো চালাচ্ছে। যেমন—ডোনেশন নেওয়া হচ্ছে, ভর্তি ফি, বেতন আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক অনেক বেশি ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থারও উদ্ভব হতে দেখা যাচ্ছে। অঙ্গীকার ভঙ্গ, ব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে চালানো—এগুলো কিন্তু অনৈতিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে নৈতিকতা শেখার স্থান। অথচ এখানে যদি ঘোষিত নীতিমালাই মানা না হয়, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা কী শিক্ষা পাবে সেখানে? এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক! সরকারি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও যে ধোয়া তুলসীপাতা, তা কিন্তু নয়। এগুলোতেও নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়। এদের মধ্যে দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য কথাগুলো আজকাল অভিধানে পাকা জায়গা করে নিয়েছে।
এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠছে বা গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন উর্বর জমি ক্রয় করে বা হুকুমদখল করে (সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে)। আমরা জানি যে দীর্ঘ মেয়াদে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হলে কমপক্ষে ৫০ থেকে ১০০ একর জমির প্রয়োজন হয়। এদিকে শিক্ষাবান্ধব মহাজোট সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে ‘প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ আমি তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করি। কারণ ১৭ কোটি মানুষের দেশে অন্তত ১৭০টি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবে তা যদি বর্তমানের মতো অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে উর্বর আবাদি জমি ক্রয় বা হুকুমদখল করে গড়ে তোলা হয়, তাহলে এত জমি কি পাওয়া যাবে? পেলেও কি করা ঠিক হবে? শুধু কি বিশ্ববিদ্যালয়? একই কায়দায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মক্তব ইত্যাদি। কী পরিমাণ আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে এতে? ভাবলে শিউরে উঠতে হয়! ভবিষ্যতে কি ধান উৎপাদনের জন্য জমি থাকবে অবশিষ্ট? কী খেয়ে বাঁচব আমরা? লেখাপড়াই বা কিভাবে চলবে? এটা টেকসই উন্নয়নের ধরন হতে পারে না। বর্তমানের স্বার্থে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থহানি করতে পারি না। তাহলে প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। এটা নৈতিকতার প্রশ্ন। এ প্রশ্নের জবাব এখনই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। দেশের প্রত্যেক নাগরিক, বিশেষ করে নীতিনির্ধারণী মহলকে বিষয়টি নিয়ে ভেবেচিন্তে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এগোনো প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলের সুবিবেচনার জন্য কিছু পরামর্শ নিচে তুলে ধরছি :
১. নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জায়গায় করতে হবে—এ ধারণা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশ আয়তনের দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র, অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে বেশ বড়। শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে বর্তমানে আমি বলব জমির যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। এটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। আমাদের স্বল্পায়তন দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি সংস্থা ও কলেজগুলোর অব্যবহৃত জমিকে প্রাধান্য দিতে হবে। একান্ত প্রয়োজনে অনুর্বর ও অব্যবহৃত জমি সীমিত আকারে হুকুমদখল করা যেতে পারে। তবে না করে পারলেই উত্তম।
২. বিদ্যমান স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত দুই শিফটে লেখাপড়ার নিয়ম চালু করা হোক। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতি সহজেই তিন শিফট চালু করা সম্ভব।
৩. শিফটগুলোর সময়কাল হবে এ রকম—সকাল ৭টা থেকে ১২টা; ১৩টা থেকে ১৮টা এবং ১৯টা থেকে ২৪টা পর্যন্ত। সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা (আলমারি, টেবিল-চেয়ার, ডেস্ক ইত্যাদি) বৃদ্ধির মাধ্যমে একই ক্লাসরুম, বিভাগীয় প্রধান বা সভাপতির কক্ষ ইত্যাদি অতি সহজেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিফটে ব্যবহার করা যাবে। উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই তিন শিফটে লেখাপড়া চলছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
৪. প্রয়োজনীয় লোকবলের বিষয়টির সমাধান হচ্ছে আমার মতে এ রকম—বিদ্যমান লোকবলকে (শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ অন্যান্য) দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিফটে খণ্ডকালীন ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। অবশ্যই এটা হবে ঐচ্ছ্যিক। কাউকে বাধ্য করা যাবে না। আমার ধারণা, বেশির ভাগই রাজি হবে। তার পরও যদি দরকার হয়, তাহলে কিছু নতুন নিয়োগ দিতে হবে।
৫. নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জেলা শহরের বড় বড় কলেজকে প্রাধান্য দিতে হবে। এগুলোতে অনেক অব্যবহৃত জমি ও অবকাঠামো রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হলে এখানে স্বল্প খরচে বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আর দুই শিফট চালু করতে পারলে তো কথাই নেই। অনেক সাশ্রয় হবে। লোকবলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ অন্যান্য লোকবল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার তারিখে যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণ হবে।
৬. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো, বিশেষ করে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। ১০ তলার নিচে কোনো ভবন নির্মাণ মোটেও ঠিক হবে না। সম্ভব হলে ২০ তলাবিশিষ্ট টাওয়ার ভবন করতে হবে। এসব ভবন হবে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন। প্রয়োজনে উন্নত দেশের আদলে এ বিষয়ে সংসদে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। যত শিগগির তা হয় ততই মঙ্গলময় হবে দেশের ভবিষ্যৎ।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়