টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা মহাজোট সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনসহ শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন ও সংস্কার আনয়নে সক্ষম হয়েছে। এতে গোটা শিক্ষা পরিবারের মধ্যে চাঞ্চল্য ও স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করছে। এ যাত্রা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে আরো নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ, পরিবর্তন ও সংস্কার করা হবে, আমরা আশা করি। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের যত সমালোচনা থাকুক না কেন, হাতে গোনা দু-একটি বিষয় নিয়ে তাদের হোঁটচ খেতে হলেও পরবর্তী সময়ে তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস ছিল সেগুলোর মধ্যে একটি বিষয়। কিন্তু গত দুই বছরে তারা প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, শিক্ষার গুণগত মানের বিচারেও সরকার অনেক এগিয়েছে। ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন ও মানোন্নয়ন দ্রুত হবে বলে আশা করি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার উন্নয়ন, পিইসি পরীক্ষার প্রবর্তন, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য শৌচাগারের ব্যবস্থা গ্রহণ, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ঢালাওভাবে এমপিও না করে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতির মধ্যে আনয়ন, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ জাতীয় করা গত সরকারের ভালো পদক্ষেপ ছিল। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজন ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছা প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এমন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবছে সরকার। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দীর্ঘদিনের। তাঁদের নামমাত্র বাড়িভাড়া দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের মেয়াদের শেষে তাঁদের বৈশাখী ভাতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট প্রদান তাঁদের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনবে বলে আমরা মনে করি। আমাদের বিশ্বাস, সরকারের এ মেয়াদে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয় করা সম্ভব হবে এবং সরকারের এমন অঙ্গীকারও রয়েছে।
কর্মসংস্থানভিত্তিক শিক্ষা আমাদের উন্নয়নের প্রধান সোপান। শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যে মুহূর্তে আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করছি, পরক্ষণেই আমাকে ভাবতে হবে—এখান থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা কোথায় নিজেকে কাজে নিযুক্ত করবে। কর্মসংস্থান দেশে হতে পারে আবার হতে পারে বিদেশে। তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে দেশীয় কর্মসংস্থানের বিষয়টি। শুধু উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি নিয়েই ভাবলে চলবে না, আমাদের অদক্ষ ও স্বল্পশিক্ষিত জনবল নিয়েও ভাবতে হবে।
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রথম আমাদের দরকার পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগ অবশ্যই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসতে হবে। বর্তমানে আমাদের জিডিপির যে অংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়, তা পর্যাপ্ত নয় বলে আমরা মনে করি। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, সঠিক পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনা আমাদের পারবে শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে। আমাদের শিক্ষার স্তর মূলত তিনটি। প্রতিটি স্তরে সমান গুরুত্ব দেওয়া যেমন দরকার, তেমনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিককে বিশেষভাবে দেখা দরকার। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ভাবনা একটু ভিন্ন হবে। কেননা এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রাথমিক শিক্ষা আনন্দদায়ক ও মূল ভিত্তিতে থাকা উচিত। কম্পিউটার, প্রজেক্টরসহ সব আধুনিক শিক্ষা উপকরণ থাকবে, যার ফলে ঝরে পড়ার হার কমবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা পরবর্তী জীবনের দিকনিদের্শনা দিয়ে থাকে। নিজ নিজ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এখানে শিক্ষার্থীরা বিভাগ নির্বাচন করে। এখানেও তাদের ভিত্তি রচিত হয়। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও আরো উন্নত ও জুতসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর একজন শিক্ষার্থী তার কর্মসংস্থানের কথা ভাবে; কিন্তু তার ভাবনা রচিত হয় আগে থেকেই। তার কর্মসংস্থান কোথায় হবে, তা যদি নির্দিষ্ট থাকে, তাহলে তার মধ্যে হতাশা কাজ করবে না। বিশেষায়িত চিন্তাভাবনা উচ্চশিক্ষায় তৈরি হলে আশার আলো পাওয়া যায়।
বিগত বছরগুলোতে আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু সেই অনুপাতে টেকনিক্যাল স্কুলের সংখ্যা বাড়েনি। আমাদের বহুদিনের দাবি, প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা; কিন্তু আজ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে নই; কিন্তু তার পাশাপাশি আমাদের নিচু স্তরে টেকনিক্যাল শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আশা করি, নতুন সরকার টেকনিক্যাল শিক্ষা বিস্তারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র:কালের কণ্ঠ