অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নিয়মিতই ছিল তাসনুভার বিদ্যালয়ে উপস্থিতি। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর তা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। আর গত বছর বন্ধই হয়ে যায় তার বিদ্যালয় গমন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেও আর বিদ্যালয়মুখী করতে পারেনি তাসনুভাকে।
সিলেটের বিশ্বনাথের রামপাশা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভার পড়ালেখা বিয়ের কারণে থেমে গেলেও আসাদুল ইসলাম অনিয়মিত হয়ে পড়ে দারিদ্র্যের কারণে। পরিবারে বাড়তি রোজগারের তাগিদে দশম শ্রেণীর গণ্ডি আর পেরোনো হয়নি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের চানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থীর। সোমবার (১৮ নভেম্বর) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
জরিপের তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় নবম-দশম শ্রেণীর প্রায় ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থীই শ্রেণীকক্ষে অনুপস্থিত থাকছে। তাসনুভা, আরিফুলের মতো অনেকে একপর্যায়ে ঝরেও পড়ছে। যদিও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার বাড়াতে উপবৃত্তি ও মিড ডে মিলের মতো কর্মসূচি চালু রয়েছে।
প্রতি বছরের মতো এবারো শিশুদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে জরিপ চালিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। এতে সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপের ভিত্তিতে ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে ইউনিসেফ বাংলাদেশ। জরিপের ফলাফল বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতির হার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই অনুপস্থিত থাকছে।
দারিদ্র্যকেই বিদ্যালয়বিমুখতার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি বাল্যবিবাহকেও এজন্য দায়ী করছেন তারা। তাদের মতে, অভিভাবকদের নিম্ন আয়ের কারণে উপার্জনমূলক বিভিন্ন কাজে নামতে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী সময়ে অনুপস্থিত থাকা এসব শিক্ষার্থীই একপর্যায়ে শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, উপবৃত্তি ও স্কুল ফিডিংয়ের মতো নানা উদ্যোগে প্রাথমিকের শিশুরা অনেকটাই বিদ্যালয়মুখী। তারা উৎসাহ নিয়ে শ্রেণীকক্ষে যাচ্ছে। পরবর্তী ধাপগুলোতেও এ মডেল অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রথম ধাপই হলো বিদ্যালয়ের অনুপস্থিতি। বিদ্যালয়ের অনুপস্থিত থাকার ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক কারণ যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে রয়েছে ভৌগোলিক কারণও। আবার দরিদ্র অভিভাবকরাও পরীক্ষাকেন্দ্রিক নোট-গাইড ও কোচিং ফি বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় বহনে ব্যর্থ হচ্ছেন। সব মিলিয়ে বিদ্যালয়বিমুখ হচ্ছে মাধ্যমিক পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী।
ইউনিসেফের জরিপ প্রতিবেদনে বিভাগ ও জেলাভিত্তিক শিক্ষার্থী উপস্থিতির চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, পাহাড়, হাওড়, উপকূল ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের জেলাগুলোয় শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার সবচেয়ে কম।
হাওড় অঞ্চলের জেলাগুলোর একটি সুনামগঞ্জ। বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের মতো দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের বিদ্যালয়গুলোয় নবম ও দশম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার মাত্র ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ। এ হিসাবে জেলাটির দুই-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পুলিন চন্দ্র রায় বলেন, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব ও দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ। এছাড়া দারিদ্র্যের কারণেও অনুপস্থিত থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তবে আগের তুলনায় এ হার এখন অনেক কমেছে।
বিদ্যালয়ে উপস্থিতির তালিকায় পিছিয়ে রয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানও। এ জেলার আয়তন ও জনগোষ্ঠীর তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম। তাই শিক্ষার্থীদের দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। এ জেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় নবম ও দশম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার মাত্র ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ। সে হিসাবে এ জেলায়ও শিক্ষার্থীর বড় অংশই বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে অতিমাত্রায় দুর্যোগপ্রবণ দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রাম। বন্যা, খরা, নদীভাঙন, শৈত্যপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় এ জেলার বাসিন্দাদের। এসব এলাকায় শিক্ষার সুযোগটা তাই স্বাভাবিকভাবেই কম। কুড়িগ্রামের বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সে হিসাবে এ জেলায়ও নবম ও দশম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছে।
নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী উপস্থিতিতে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অন্য জেলাগুলোর মধ্যে আছে কিশোরগঞ্জও। জেলার শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার মাত্র ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নবম ও দশম শ্রেণীর ৩৪ দশমিক ৫, কক্সবাজারের ৩৫, সিলেটের ৩৮ দশমিক ২, নারায়ণগঞ্জের ৩৯ দশমিক ৯, ময়মনসিংহের ৪১ দশমিক ৬ ও হবিগঞ্জে ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে বিদ্যালয়ে।
বিভাগভিত্তিক উপস্থিতির হারে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট। ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী, এ বিভাগের নবম ও দশম শ্রেণীর ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। অনুপস্থিতির হার সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যান্য বিভাগের মধ্যে খুলনায় অনুপস্থিতির হার ৪৪ দশমিক ৭, রাজশাহীতে ৪৮, রংপুরে ৪৯ দশমিক ৪, ঢাকায় ৫২ দশমিক ১, ময়মনসিংহে ৫৩ দশমিক ৮ ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান বলেন, ইউনিসেফ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির হারের যে তথ্য দিয়েছে, সেটি আমার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। তবে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির হার বেশি, সেটি সত্য। বিশেষ করে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে এ হার অনেক বেশি। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে না গিয়ে পরিবারের জন্য উপার্জনে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে সরকার মিড ডে মিলসহ নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু উদ্যোগের বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। বিদ্যালয়ের উপস্থিতির হার বাড়ানোর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ঝরে পড়া কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিক স্তরে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থীই ঝরে পড়েছে। ২০১৭ সালে এ হার ছিল ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে এ হার ছিল ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।