৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ দিবসের আমাদের দেশে তথা সারা বিশ্বে নারীদের নিয়ে আলোচনা সভা, সেমিনার, র্যালি আয়োজন করা হয়। সংবাদমাধ্যমে নারীর সাফল্য নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তথা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। টেলিভিশনেও চলে টকশো, বিশেষ নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফেসবুকে চলে নারী দিবসের শুভেচ্ছা। এক কথায়, এ একটা দিন গোটা বিশ্ব আলাদা করে মনে করে নারীরাই এই জগতের শক্তির উৎস আর প্রেরণা। আজ এ দিবসে কৃষিতে উচ্চশিক্ষার নারীদের এগিয়ে চলা, তাদের কর্মজীবনকে স্বাগত জানিয়ে এ লেখাটি লিখছি। বুধবার (১১ মার্চ ) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপ- সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। আরও জানা যায়,
উপ-সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার নারী কবিতায় লিখেছেন ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। তার কবিতার এই মর্মবাণী শতভাগ সত্যি প্রমাণ হলো বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য কবি এ কথাগুলো এখন সবাংশে সত্যি হয়ে উঠেছে কৃষিতে নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে। মেধা মননে কিংবা সৃষ্টশীল কাজে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই তারা। ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে কৃষি ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, প্রয়োগ, কৃষি গবেষণায় যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করে চলেছে আজকের কৃষি কন্যারা।
গত ৩০ নভেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো কৃষিবিষয়ক সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন প্রশ্নে ভর্তির দিকে তাকাই। তাহলে দেখব, কৃষি শিক্ষা উচ্চশিক্ষায় ভর্তি ক্ষেত্রে প্রথমবারে মতো ছাত্রদের পেছনে ফেলে ছাত্রীরা এগিয়ে। এ সাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যত শিক্ষার্থী মনোনীত হয়েছে, তাদের মধ্যে ৫০ দশমিক ৪২ শতাংশই ছাত্রী। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৬০৩ জন ও ছাত্র ৫০৫ জন। অর্থাৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ভর্তির হার ৫৪ শতাংশের বেশি। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫১ জন ছাত্রী ও ৩২০ জন ছাত্র। অর্থাৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ভর্তির হার ৫২ শতাংশ। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫০টি আসনের বিপরীতে ভর্তি হয়েছে ১৪২ জন। এর মধ্যে ৭৫ জন ছাত্রী, বাকি ৬৭ জন ছাত্র। আমি মনে করি, নারী শিক্ষার জন্য সরকারের নানা ধরনের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন কারণে এখন নারীরা শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে। এর আগে চিকিৎসা শিক্ষাতেও নারীর সংখ্যা পুরুষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত শিক্ষাবর্ষে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ ছাত্রী এবং ৪০ শতাংশ ছাত্র ছিলেন। এছাড়া আরও কয়েক বছর আগেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ভর্তিতে ছাত্রদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় ছাত্রীরা। এখন এই দুই স্তরেই মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী বেশি।
বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৮ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে চারটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৪৪ শতাংশ ছাত্রী অধ্যয়নরত। ২০০৯ সালে ছিল ৩০ শতাংশ। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ ছাত্রী বর্তমানে অধ্যয়নরত। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে- কৃষি শিক্ষার নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে চলছে। শুধু কী লেখাপড়া, শিক্ষকতা পেশা এ ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ শতাংশ নারী জড়িত রয়েছে।
চারটি পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ যে সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে এখানকার প্রতিটি ছাত্রীই তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে। শিক্ষক আর গবেষকদের নয়া প্রযুক্তি নিয়ে মাঠপর্যায়েও তারা কৃষাণ-কৃষাণিদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে, পরামর্শ দিচ্ছে। ভালো ফলাফল করার জন্য মেয়েরা আজ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী পদক থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশা থেকে শুরু করে বিসিএস, বিএডিসি, বিআরআরআই, বিএআরআই, এসআরডিআইসহ বিভিন্ন সরকারি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, এনজিও, ব্যাংক, কোম্পানি, আখ, পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর মতো সাফল্যও রয়েছে তাদের ঝুলিতে। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের এ সাফল্য যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে নারী কৃষি শিক্ষার গুরুত্ব তেমন সমৃদ্ধ করছে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
কৃষি শিক্ষা নারী অংশগ্রহণ বাড়লেও চাকরিতে অনেক পিছিয়ে। উচ্চশিক্ষা শেষ করেও পারিবারিক ও সামাজিক বাধায় অনেক নারী চাকরি করেন না বা ইচ্ছা থাকলেও করতে পারেন না। যে কারণে শিক্ষা জীবন শেষে চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও কম। কিন্তু যে ক’জন চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন তারা যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে টিকে আছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার চাকরিতে পিছিয়ে আছে নারীরা। ৩৭ তম বিসিএসে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোট ৪৬ জনের মধ্যে নারী ১০ জন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ০১ জনের মধ্যে নারী ১ জন, মৎস্য কর্মকর্তা ১৯ জনের মধ্যে নারী ৯ জন। তবে পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর এসব স্তরেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
আমাদের প্রতি বছরই প্রতিনিয়ত বাড়ছে জনসংখ্যা তার সঙ্গে কমে যাচ্ছে চাষযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ। এমন প্রতিকূল পরিবেশেও সরকারের নানা কৃষি সেবামূলক কর্মকা- পরিচালনায় পুরুষদের সঙ্গে অভূতপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন নারী কৃষিবিদরা। কৃষকরতœ শেখ হাসিনার নারীর ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ আজকের নারী কৃষিবিদ। মূলত ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীয় মর্যাদা দেয়া পর থেকেই নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় হাতেগোনা কয়েকজন মেয়েই কৃষিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করত। আজ নারী কৃষিবিদগণ মেধা মননে কিংবা সৃষ্টিশীল কাজে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। সার মনিটরিং, বীজ মনিটরিং, কীটনাশক মনিটরিং, মাঠ দিবস, কৃষক পরামর্শ, প্রণোদোনা বাস্তবায়ন, কৃষি যান্ত্রিকরণ সেবা, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপত্র প্রদানে ফসল মাঠ ভিজিট, কীটনাশক লাইসেন্স প্রদানে কাজ করা ছাড়াও দাপ্তরিক নানা কাজ করছেন নারী কৃষিবিদরা। এরা ছুটে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, কৃষকের হৃদয়ের কাছে। যেখানে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে গর্বিত ইতিহাস। আর তাই এখন সবাই বলে গ্রাম আর এখন সে গ্রাম নেই, বদলেছে এর অনেক কিছু। সে সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের যাপিত জীবন। এ কাজে গতি বৃদ্ধিতে পুরুষ কৃষিবিদদের সঙ্গে ভূমিকা পালন করছে নারী কৃষিবিদরাও। তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ মাঠে যারা সরাসরি কৃষি তথা কৃষকের সঙ্গে কাজ করে, দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে।
এখানে আমি আরও কিছু কথা বলতে চাই। নারী কি শুধু পুরুষ দ্বারাই অধিকার বঞ্চিত বা নির্যাতিত হয়? নারী নিজেই কি মাঝে মাঝে আরেক নারীর সাফল্যের পেছনে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে না? আমি নিজে নারী হয়ে সফলতা পাইনি বলে আরেক নারীর সফলতা দেখে কেন আমি ঈর্ষাপরায়ণ হবো? কেন আমার মাঝে এই চিন্তা কাজ করবে না যে আমিও সফল হবো, আমিও স্বপ্ন দেখব এবং সেটা বাস্তবায়নও করব? তাই আমাদের নারীদেরও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। হয়তো বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রতিটা মেয়ে কর্মক্ষেত্রে জড়াতে পারে না বা সুযোগ হয়ে ওঠে না। দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক কাঠামো ইত্যাদি নানা কারণই এর পেছনে কাজ করতে পারে। আবার দেখা যায় অনেক শিক্ষিত নারীও আছেন যারা গৃহিণী হয়েই থাকতে পছন্দ করে, ঘর দেখাশোনা এবং সন্তানের লালনপালন করে। আমি বলছি না এটা খারাপ কিন্তু ঘরে থাকবে বলেই কেন তাদের চিন্তা-ভাবনা টিভি সিরিয়াল, শাড়ি গয়নায় আবদ্ধ হয়ে যাবে! চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে বের হতে হবে, নিজের সচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে নিজের করণীয় কাজগুলো বুঝে নিতে পারে, দৃষ্টির প্রসারতা বাড়াতে হবে।
নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ‘আমাকে ভালো মা দাও, আমি তোমাদের ভালো জাতি দেব।’ সুতরাং নারীকে শুধু নারী হিসেবে না দেখে তাকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। নারীকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে দেখতে চাইলে নারীর মধ্যে স্বাভাবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। তাদের সুশিক্ষিত তথা স্বশিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে।
নারী শিক্ষার উন্নয়নের ফলে একদিকে যেমন নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে অন্যদিকে তারা তাদের মেধা ও প্রতিভা দিয়ে কৃষি সেক্টরে চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করছে। নারী স্ব স্ব অবস্থানে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা নিয়ে নারী দিবসে বাংলাদেশের সব নারীকে জানাই সংগ্রামী শুভেচ্ছা, আর পৃথিবীর সব নারীর জন্য শুভকামনা। শুধু নারী দিবস বলেই একটি নির্দিষ্ট দিনে আমরা নারীদের নিয়ে ভাবব, তাকে সম্মান দেব তা নয়। আসুন আমরা নারীকে তার যথাযথ সম্মান দেই, তাকে দেই তার সদিচ্ছা পূরণের অধিকার, তাকে ভাবতে শিখি স্বতন্ত্র একজন মানুষ হিসেবে।
লেখক : মো. বশিরুল ইসলাম।