নিবন্ধন ছাড়াই চলছে কিন্ডারগার্টেন - দৈনিকশিক্ষা

নিবন্ধন ছাড়াই চলছে কিন্ডারগার্টেন

নিজস্ব প্রতিবেদক |

সরকারিভাবে নিবন্ধনের আইন হওয়ার পাঁচ বছর পরও অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ই অনিবন্ধিত রয়ে গেছে। সারা দেশে এসব স্কুলের সঠিক সংখ্যা নিয়ে যেমন অস্পষ্টতা আছে, তেমনি এর শিক্ষাব্যবস্থারও কোনো তদারকি নেই।

কিন্ডারগার্টেন হলো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব স্কুলে মূলত প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। কিছু কিন্ডারগার্টেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ায়।প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ যাবৎ মাত্র ৬১৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। গত বছর অধিদপ্তর দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর যে শুমারি করেছিল, সেটা অনুযায়ী সারা দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩১৮। অন্যদিকে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদ (বিকপ) বলছে, এমন স্কুল আছে প্রায় ৬৫ হাজার।Capture

১৯৬২ সালের রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, ২০১১ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা প্রণীত হয়। পরের বছর সংশোধিত বিধিতে এলাকাভেদে প্রাথমিক অনুমোদন, অস্থায়ী নিবন্ধন ও চূড়ান্ত নিবন্ধনের জন্য ফির পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া আরও কিছু নিয়ম শিথিল করা হয়।বিধিমালা অনুযায়ী নিবন্ধনের তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপে প্রাথমিক অনুমতির জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালকের কাছে আবেদন করতে হবে। উপপরিচালক নিজে স্কুলটি ঘুরে দেখে এবং আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া কাগজপত্র পরীক্ষা করে অধিদপ্তরে তাঁর মতামত পাঠাবেন।এরপর অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত মূল্যায়ন কমিটি সেই আবেদন যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিক অনুমোদনের সুপারিশ করবে। প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়ার এক বছরের মধ্যে অস্থায়ী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে। আর অস্থায়ী নিবন্ধন পাওয়ার তিন বছরের মধ্যে চূড়ান্ত পর্বে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে। পাঁচ বছর পর নিবন্ধন নবায়ন করতে হবে।

নিবন্ধনের পরিস্থিতি

এ পর্যন্ত মূল্যায়ন কমিটির চারটি সভায় ৬১৪টি কিন্ডারগার্টেনকে প্রাথমিক অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পলিসি অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এই স্কুলগুলোর ২৮৩টিই ঢাকা বিভাগের। কমিটি চট্টগ্রাম বিভাগের মাত্র তিনটি এবং সিলেট বিভাগে মাত্র পাঁচটি কিন্ডারগার্টেনকে সুপারিশ করেছে। রংপুরে সুপারিশ পেয়েছে ১৫৪টি, খুলনায় ১১২, রাজশাহীতে ৪৮ এবং বরিশালে ৯টি। আর নতুন বিভাগ ময়মনসিংহের কোনো কিন্ডারগার্টেনই প্রাথমিক অনুমোদনের সুপারিশ পায়নি।প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়া এই ৬১৪টি কিন্ডারগার্টেনের কোনোটি নিবন্ধনের চূড়ান্ত ধাপ পার করেছে কি না, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তা বলতে পারেনি।

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সিংহভাগ কিন্ডারগার্টেন স্কুলেরই নিবন্ধন নেই। নারায়ণগঞ্জ কিন্ডারগার্টেন পরিচালক ঐক্য পরিষদের স্থায়ী কমিটির সদস্য নুরুননাহার হক বলেন, সম্প্রতি ৮০টিরও বেশি স্কুল প্রাথমিক অনুমোদন পেতে আবেদন করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই কিন্ডারগার্টেনগুলো সরকারি নিয়ম-নীতিতে চলুক। তাই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদ (বিকপ) বলছে, চার বছর আগে তাঁদের নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেই কর্তৃপক্ষ নিবন্ধনের বিধিমালা সংশোধন করেছিল। বিকপের মহাসচিব রেজাউল হক বলেন, প্রাথমিক অনুমোদনের জন্য আবেদন করার ৬০ দিনের মধ্যে বিভাগীয় উপপরিচালকের স্কুল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে পরিদর্শন করা হচ্ছে না। ফলে মূল্যায়ন কমিটির কাছে বিভাগীয় উপপরিচালকের প্রতিবেদন যেতে দেরি হচ্ছে। এতে নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়াই ঝুলে যাচ্ছে। আবার অনেক স্কুলের কর্তৃপক্ষ আবেদন করতে উৎসাহ হারাচ্ছে।

রেজাউল হকের মতে, স্কুল পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। তা না হলে সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়ার হার বাড়ানো সম্ভব না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক বলছেন, মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে স্কুল পরিদর্শনসংক্রান্ত আইনে কী সংশোধন আনা যায়, তা জানতে চেয়েছে। অধিদপ্তর বিভাগীয় উপপরিচালকদের এ ব্যাপারে চিঠিও দিয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার পর করণীয় ঠিক হবে।

মো. আনোয়ারুল হক বলেন, একেকটি বিভাগে অনেকগুলো কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। বিভাগীয় উপপরিচালকের একার পক্ষে দ্রুত এগুলো ঘুরে দেখা কষ্টসাধ্য। মূল্যায়ন কমিটির চতুর্থ সভায়ও উপপরিচালকেরা পরিদর্শন করেননি এমন বিদ্যালয়ের আবেদন ছিল। সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়েছে।

মো. আনোয়ার বলেন, মোট ৯০০ বিদ্যালয়ের আবেদন ফেরত গিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আবেদনপত্র পূরণে ভুল ছিল। অনেকে সঠিকভাবে তথ্য দেননি। ফলে সেই সব আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি। এগুলোকে আবার কাগজপত্র দিতে বলা হয়েছে। তাঁর আশা, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে অনেকগুলো কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধিত হয়ে যাবে।

কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষা

রাজধানীর আজিমপুরের একটি পাঁচতলা ভবনের সবগুলোতেই কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারের অফিস। সেই ভবনেরই চারতলায় একটি কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়। বাংলামাধ্যমের এই বিদ্যালয়ের সবগুলো ঘরই কাঠের বেঞ্চে ঠাসা। ক্লাস চলছে বারান্দায়ও। খেলার জায়গা বলতে এক টুকরো ব্যালকনি। ২০১১ সালের বিধিমালায় নিজস্ব মালিকানা বা ভাড়ায় স্কুলের জন্য নেওয়া জমির পরিমাণ এলাকাভেদে আট, ১২ ও ৩০ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। সংশোধিত বিধিতে বলা হয়, এর চেয়ে কম জমিতে হলেও বিদ্যালয়গুলো নিবন্ধন পাবে। গত বছর গণসাক্ষরতা অভিযানের একটি সমীক্ষায় সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর একটি তুলনামূলক চিত্র দেওয়া হয়েছে। ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০১৫, মুভিং ফ্রম এমডিজি টু এসডিজি’ নামের এই সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, ২০১৪ সালে মাত্র ৪৯ শতাংশ কিন্ডারগার্টেনের নিজস্ব ভবন ছিল। অর্থাৎ দেশের অর্ধেকের মতো কিন্ডারগার্টেনই চলছিল ভাড়াবাড়িতে। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার খুবই কম। গণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষাটি বলছে, ২০১৪ সালে কিন্ডারগার্টেনগুলোর শিক্ষকদের মাত্র ১৫ শতাংশ ছিলেন প্রশিক্ষিত। একই সময়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার ছিল ৯৪ শতাংশ। নারায়ণগঞ্জের নিউ খানপুর ব্যাংক কলোনি এলাকার আনন্দ বিদ্যাপীঠ এখনো নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেনি। স্কুলটির অধ্যক্ষ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রতি শ্রেণিতে গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী আছে। ভাড়া বাসায় জায়গা কম, তাই শিক্ষার্থী ভর্তিও করা হয় কম। সরকারি বিধিমতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আদর্শ শ্রেণিকক্ষ হবে ৫০৭ বর্গফুট। এডুকেশন ওয়াচ ২০১৫ অনুযায়ী, কিন্ডারগার্টেনগুলোর শ্রেণিকক্ষের মাত্র ৩ শতাংশ এই শর্ত পূরণ করে। এ ছাড়া কিন্ডারগার্টেনগুলোর মাত্র ১৭ শতাংশের পাঠাগার আছে।

২০১২ সালের সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী, কিন্ডারগার্টেনগুলোকে অবশ্যই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যবই পড়াতে হবে। এর বাইরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তালিকাভুক্ত যুগোপযোগী অন্যান্য বইও পাঠ্যক্রমে রাখা যাবে। এ ছাড়া সরকারের ঠিক করে দেওয়া অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত অথবা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিক্ষাক্রম অনুসরণ করতে হবে। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন, কিন্ডারগার্টেনগুলো শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বইয়ের বোঝা চাপায়। রাজধানীর বাসাবোর সেন্ট্রাল কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান অবশ্য এই অভিযোগ নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্রেও বোর্ডের কথা পুরোপুরি মানা হয়। রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের সিনিয়র শিক্ষক নূরুন নাহার লিপি। সাত বছর বয়সী ছেলে রাদিয়ান দিব্যকে তিনি একটি স্থানীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি করিয়েছিলেন। তাকে নয়টি বই দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, অন্যান্য শ্রেণিতেও বেশি বেশি অতিরিক্ত বই পড়াতে দেখেছেন। শিক্ষকেরাও চাপ দেন বেশি।

কার্যকর নজরদারি নেই

কিন্ডারগার্টেনগুলো কীভাবে চলছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে তার পর্যাপ্ত তথ্য নেই। সঠিক শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতি মানা হচ্ছে কি না, তারও সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। চূড়ান্ত নিবন্ধন পাওয়া কোনো স্কুলের তদারকির সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়নি। গত ১৬ আগস্ট প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে অননুমোদিতভাবে গড়ে ওঠা নার্সারি, প্রিপারেটরি ও কিন্ডারগার্টেন ঠেকানোর জন্য টাস্কফোর্স গঠন করার কথা বলা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনটি আরও বলেছে, এসব স্কুলের পরিচালনায় কোনো নিয়মনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। টাস্কফোর্স বিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন কাগজপত্র ও তথ্য যাচাই করে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাবে। নিবন্ধনের জন্য পরিদর্শন আপাতত স্থগিত আছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আশা করছে, টাস্কফোর্সের কাজ শেষ হলে সারা দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলোর একটি সার্বিক চিত্র পাওয়া যাবে। পরিচালক মো. আনোয়ারুল বলেন, সরকার লাগামহীনভাবে চলা কিন্ডারগার্টেনগুলোকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। তবে অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050840377807617