ক'দিন আগে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নগর পরিকল্পনাবিদ বলছিলেন, 'একটি দেশ কতটা উন্নত তা বোঝা যায়, সে দেশের রাস্তার পরিকল্পনা দেখে।' মনে পড়ে, ২০১১-এর দিকে রাজধানীর কলেজ গেটের সামনে একটি গণপরিবহনের পেছনের সিটে বসা ছিলাম আমি এবং আমার ভাই। হঠাৎ দেখি আমাদের মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। ভাইয়ের ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে। আমার হাতে রাখা ল্যাপটপটি গাড়ির মেঝেতে পড়ে আছে। মনে হচ্ছিল, আমি ঘোরের মধ্যে আছি। হুঁশ যখন এলো, তখন তাকিয়ে দেখি গাড়িটা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। গাড়িতে একজন যাত্রীও নেই। আমরা দুই ভাই-বোন কোনো রকমে গাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় পড়ে রইলাম। পথচারীরা আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ভাইয়ের ঠোঁটে এবং আমার মাথায় সেলাই লাগল। ক'দিন আগে আমার আরেক সহোদর ঢাকার রামপুরার দিকে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে একটি বাস এসে ধাক্কা মেরে চলে যায়। এ ঘটনায় তার পায়ের গোড়ালির শিরায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে পাঁচটি সেলাই দিতে হয়। কয়েক মাস আগে নীলক্ষেতে ফটোকপি মেশিনের দোকানে ফটোকপির কাজ করছিলাম। হঠাৎ দেখি একটি পিকআপ এসে একটি রিকশাকে ধাক্কা মেরে চলে গেল। রিকশাওয়ালার হাত-পা কেটে গেল, রিকশার চাকাটির ক্ষতি হলো। ক'দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম একটি গণপরিবহন দিয়ে। গেণ্ডার দিকে একটি ট্রাক উল্টোপথে এসে আমাদের বাসের জানালা ভেঙে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। বাসের সব যাত্রী নিশ্চুপ থাকলেও আমি বাস থেকে নেমে চালকের সঙ্গে কথা বলে ভুক্তভোগী বাসটিকে জরিমানা আদায় করে দিই। এ তো গেল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে পাঁচ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে নিহত হয়েছে সাত হাজার ৩৯৭ জন। চলতি বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে দুই হাজার ৪৭১ জন। আহত হয়েছে ১৬ হাজার ১৯৩ জন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জাল লাইসেন্সের ছড়াছড়ি অন্তত নয় লাখ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহনের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ৫০ হাজার যানবাহন রাস্তায় চলাচল করে; যার কোনো ফিটনেস সনদ নবায়ন হয়নি। মাদকাসক্ত চালকের কারণে দেশে ৩০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দূরপাল্লার রুটে প্রতি পাঁচ ঘণ্টা পরপর চালককে বিশ্রাম দেওয়ার নিয়ম, কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ম মানা হয় না। এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটানোর মোক্ষম সময় এখনই। তবে আশার কথা এই যে, ২০১৭ সালে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন প্রদান করে মন্ত্রিসভা। কয়েকদিন আগে আইন মন্ত্রণালয় খসড়া আইনের অনুমোদন দিয়েছে।
নতুন এ আইনটির বিষয়ে যদি পর্যালোচনা করি- দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড। শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাসের শর্ত রয়েছে। এমনকি সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাসের সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। পেশাদার চালকের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর প্রস্তাব করা হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে অনধিক ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। লাইসেন্সে থাকবে ১২ পয়েন্ট। বিভিন্ন বিধি অমান্যে কাটা যাবে ওই পয়েন্ট। পয়েন্ট শূন্য হলে বাতিল হবে চালকের লাইসেন্স। গাড়ি চালানোর সময় মুঠোফোন ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে। দেরিতে হলেও এই আইন পাস হলে সড়কে নিরাপত্তা আনয়ন হবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। ফুটপাত দখলমুক্ত করার পাশাপাশি ফুটপাত, পদচারী সেতু, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো, ট্রাফিক সংকেত মেনে চলার জন্য জনসচেতনমূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা জরুরি। যত্রতত্র রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা বন্ধ করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামা বন্ধ করা, বিদ্যালয়গুলোর সামনে পদচারী সেতু অথবা স্পিডব্রেকার তৈরি করা, বিদ্যালয়গুলোর পাশে বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ করাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে সড়কে নিরাপত্তা আনয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়