নির্লজ্জতা রুচিশীল জাতি গঠনের পথে বাধা - দৈনিকশিক্ষা

নির্লজ্জতা রুচিশীল জাতি গঠনের পথে বাধা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলার লোককবিদের মরমি ভাবধারা যেমন গভীর, তেমনি তাঁরা সূক্ষ্ম পরিহাসপ্রিয়তায়ও কম পারদর্শী নন। জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার কথা তাঁরা চমৎকার উপমা-উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। জগতে সবাই যা চায়, তা পায় না। পেলেও কেউ কম পায়, কেউ পায় অপ্রত্যাশিত রকম বিপুল। তাই এক লোককবি লিখেছেন—

মওলা তুমি মালিক,
কাউকে দিলা টিয়ার বাচ্চা
কাউকে দিলা শালিক।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কথাটির ভাবসম্প্রসারণ করলে দাঁড়ায়, কেউ হয়তো আশা করেছিলেন, পাবেন কোনো ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পদ, কিন্তু দেখা গেল, সেগুলো না পেয়ে পেয়েছেন নির্বাহী কমিটির সদস্যের পদ। টিয়ার বাচ্চা মাত্র একটি—সভাপতি—কয়জনকে তা দেওয়া সম্ভব! কিন্তু যখন অনেকের শালিকছানাটিও জোটে না, তখন তাঁর ব্রহ্মতালু উত্তপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, পদ না পেলে তিনি দেশের ও দশের সেবা করবেন কীভাবে? স্বেচ্ছাসেবক হয়ে জনসেবা করতে হলে প্রয়োজন একটি পদ। মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, সরকারি দল ও তার বহুসংখ্যক ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলন উপলক্ষে এক বছরের বেশি সময় যাবৎ সমস্ত বাংলাদেশ এমন এক সাজসজ্জায় সেজেছে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশেই গণতন্ত্র আছে। সেসব দেশে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠন, এমনকি ভ্রাতৃপ্রতিমেরাও আছে, কিন্তু এই জিনিস দুনিয়ার আর কোথাও কোনোকালে কেউ দেখেনি। ব্যানার, বিলবোর্ড, প্ল্যাকার্ড, পোস্টারে বাংলাদেশ এমন সাজে সেজেছে, কোনো বড়লোকের ছেলেমেয়ের বিয়েবাড়িতেও অত সাজসজ্জা হয় না।

বিভিন্ন সংগঠনের সম্মেলনের আগে শুধু যে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে তা-ই নয়, পেরেকের দামও বেড়েছে। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনের ফ্রেমে সবার জন্য ছোট পেরেকের যেমন বিপুল চাহিদা, গাছপালায় বিলবোর্ড লাগাতে গজাল দরকার, সেটার চাহিদাও বেড়েছে। বাংলার রাস্তাঘাট ও সড়কের পাশের বৃক্ষগুলোর যদি ভাষা থাকত, তা হলে জনসেবকদের পেরেক ঠোকায় তারা আর্তনাদ করে উঠত। আমাদের জন্য স্বস্তির কথা, বৃক্ষের মানুষের মতো মুখ নেই, ভাষা নেই। তাদের যন্ত্রণা তাই আমরা জানতে পারি না।

বিলবোর্ডগুলোতে যেসব ‘নেতা’ এবং তাঁদের ‘প্রচারকদের’ ছবি শোভা পাচ্ছে, জাতিসংঘের অনেক সদস্যদেশের জনসংখ্যাও অত নয়। যে দেশের জননেতার সংখ্যা এত বেশি এবং জনসেবক লাখ লাখ, সে দেশ তো সোনার দেশ না হয়েই যায় না। যা হোক, সেটা আমাদের সৌভাগ্য; কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, ডিজিটাল ব্যানারের এই সব প্লাস্টিকের বর্জ্য খাল-বিল, নদী-নালা এবং নগরীর ড্রেনগুলোতে ফেলা হচ্ছে। বিপন্ন পরিবেশকে বিপন্নতর করা হচ্ছে নির্মমভাবে। তাদের প্রতিহত করে, এমন শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের নেই।

চাররঙা পোস্টার যে কত বিচিত্র হতে পারে, বাংলার মানুষ বাপের জন্মেও তা কল্পনা করেনি। ভাষায় রুচির পরিচয় নেই লেশমাত্র, বরং দাসসুলভ মনোবৃত্তির প্রকাশ পোস্টারে। আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রশংসায় লজ্জা-শরমের বালাই নেই। বিশ-তিরিশ বছর আগেও মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পোস্টার পড়ত, আজ ওদিকে তাকিয়েও দেখে না। দেখলেও ঘৃণাভরে তাকায়। সে যাই হোক, পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, কাগজের ওজন যদি আর একটু বেশি হতো, তা হলে দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ত পোস্টারের ভারে।

গাছপালা ও রাস্তার বিদ্যুতের খাম্বা বিলবোর্ড প্রভৃতি টাঙানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তার বাইরে প্রয়োজন হয়েছে বাঁশের খুঁটির। এত বেশি বাঁশের খুঁটি ব্যবহার করা হচ্ছে যে মৃতদেহের কবরে দেওয়ার মতো বাঁশও আমদানি করতে হতে পারে পেঁয়াজের মতো।

কিন্তু এসব তো গেল সম্মেলনের আগে পূর্বরাগ। এর পরবর্তী ধাপ হলো অনুরাগ। অনুরাগও নয় রাগ অর্থাৎ ক্রোধ বা রোষ প্রকাশ। বাঙালির ক্রোধের প্রকাশ যে কত বিচিত্র ও সাংঘাতিক হতে পারে, তা সাম্প্রতিক সম্মেলনগুলোর দৃশ্য যাঁরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন এবং দেখে শিউরে উঠেছেন, তাঁদের ছাড়া অন্য কোনো শান্তিপ্রিয় বাঙালিকে বোঝানো সম্ভব নয়। ওই দৃশ্য দেখে দুর্বল হৃৎপিণ্ডের মানুষের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। অন্যদিকে খুশি হতে পারেন প্লাস্টিকের চেয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

মারামারি জিনিসটি বাবা আদমের নাতিপুতিদের সময় থেকেই কম-বেশি চালু আছে। কিন্তু বাঙালি যেহেতু সৃষ্টিশীল জাতি, তাই সে মারামারিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। মারপিটের অভ্যাস অনেক জাতির মধ্যেই কম-বেশি রয়েছে। কিন্তু বাঙালির মতো বৈচিত্র্য কম। মারামারির দুটি প্রাথমিক পদ্ধতি ছিল হাতাহাতি এবং লাঠি ব্যবহার। কিন্তু বাঙালি দেখেছে ওগুলোই যথেষ্ট নয়। আরও বহু রকমের উপায় সে বের করেছে। যেমন থাপ্পড়। ওটা প্রধানত চোয়ালেই দেওয়া হয়। তা ছাড়া আছে কিল ও ঘুষি। কিলের তীব্রতা অপেক্ষাকৃত কম। আগে বাঙালি বউকে কিলাত। ঘুষির আঘাতের তীব্রতা বেশি। ঘুষির আঘাতে বড় জখম হতে পারে। দাঁত কয়েক পাটি পড়ে যেতে পারে। বুকের বাঁ দিকে লাগলে মৃত্যুও হতে পারে। বাঙালি ঘুষিতে সিদ্ধহস্ত শুধু নয়, পা দুটিকেও ব্যবহার করে। লাথির আঘাত মূলত কোমরের নিচের অংশেই হানা হয়। তাতে কোনো স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গে বেকায়দায় লাগলে মৃত্যু ঘটা সম্ভব।

সদাশয় সরকার স্কুল-মাদ্রাসাগুলোতে শিশুদের শারীরিকভাবে নির্যাতন নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু দলীয় সম্মেলনে নেতা-কর্মীদের মারামারি নিষিদ্ধ করেনি। তার ফলে এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, দলীয় সম্মেলনগুলোতে ফাল্গুনের শুকনো পাতার মতো উড়ছে প্লাস্টিকের চেয়ার। ফাটছে মাথা, ভাঙছে দাঁত, চূর্ণ হচ্ছে হাত-পায়ের হাড়। কেউ হারাচ্ছে চোখ বা কান। কারও শারীরিক আঘাত বিশেষ নয়, কিন্তু জামা বা পাঞ্জাবিটা হয়েছে ফালাফালা। কারও সম্মেলন উপলক্ষে কেনা হাতাকাটা জ্যাকেটটা ছিঁড়ে গেছে। সম্মেলনে গিয়ে কেউবা হানাহানিতে হারিয়ে এসেছেন তাঁর বাইফোকাল চশমাটা। এমন সব কসরত-ধস্তাধস্তির দৃশ্য দেখা গেল, যা কুস্তিগিরদের হার মানায়। সম্মেলন থেকে অনেকেই বাড়িতে যেতে পারেননি, ঠাঁই হয়েছে হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে।

মারপিটে বাঙালির এমন কিছু বিশেষ পদ্ধতি আছে, তা বেদনাদায়ক নয় কিন্তু অপমানকর। শারীরিক জ্বালা বিশেষ নেই কিন্তু অন্তর্জ্বালা দীর্ঘস্থায়ী। যেমন কানমলা, জুতাপেটা। লাঠির বাড়ির আঘাতের চেয়ে জুতা-স্যান্ডেলের বাড়ির আঘাতের তীব্র যন্ত্রণা অনেক বেশি। বাঙালির মারামারিতে উপলক্ষের অভাব হয় না। মঞ্চের আসনে বসা নিয়ে মারামারি হতে পারে, দর্শকের সামনের সারিতে বসা নিয়ে রক্তপাত হতে পারে, সভাপতি, প্রধান অতিথি হওয়া নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড হতে পারে। সংগঠনের নতুন কমিটি গঠন নিয়ে তো যা খুশি তাই হওয়া সম্ভব। একপর্যায়ে কারও জীবন পর্যন্ত যেতে পারে।

মারামারিতে বাঙালির অবশ্য কোনো উপলক্ষের অভাব হয় না। স্থান, কাল, পাত্রের বাছবিচার নেই। জাতীয় দিবসগুলোতে শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধে মারামারি। দলের নেতার কবরে পুষ্পস্তবক দিতে গিয়ে মাথা ফাটাফাটি। ইফতার মাহফিলে প্লেট-পিরিচ, শরবতের গেলাস ও চেয়ার ছোড়াছুড়িতে হত না হলেও আহত হওয়া এখন সাংবাৎসরিক ব্যাপার।

দল ও সংগঠনগুলোর সম্মেলনগুলোতে যা ঘটছে, তা সামান্য ব্যাপার নয়, প্রথম শ্রেণির সন্ত্রাস। মারামারি, সন্ত্রাস ফৌজদারি অপরাধ এবং দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য। পদপ্রার্থী হয়ে নিজের দলের মানুষের সঙ্গেই যাঁরা মারামারি করতে পারেন, পদপ্রাপ্তির পর তাঁরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন, তা বালকেও বোঝে।

যে হারে বাংলাদেশে জিডিপি বাড়ছে, তার চেয়ে দশ গুণ বেশি হারে বাড়ছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য। নির্লজ্জ চাটুকারিতা, পদলেহন, তদবির একটি জাতির উন্নতির পথে প্রধান বাধা। তার ফলে জাতি মধ্য আয়ের দেশ হলেও একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না। আমাদের ছ্যাবলামো ও নির্লজ্জতা এমন একটি পর্যায়ে নেমেছে, তাতে একটি উন্নত, মার্জিত, রুচিশীল জাতি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার সুখ থেকে আমরা বঞ্চিত হতে যাচ্ছি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00388503074646