বাংলাদেশে প্রায় সব দপ্তরে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া যায়। উত্থিত বিভিন্ন অভিযোগ কখনও কখনও আমলে নেওয়া হয়, আবার কখনও হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ ও সুষ্ঠু তদন্ত সম্পন্ন হতে দেখা যায়। কিন্তু এমন অনেক নজির রয়েছে, অভিযোগ প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও ওই বিষয়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। উল্লেখ্য, গত কয়েক মাস আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে একই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়োগ বাণিজ্য এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তোলেন। অভিযোগগুলোর মধ্যে বেশ কিছু যথার্থতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ওই পদে বহাল রয়েছেন। সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ড. সুলতান মাহমুদ রানা।
এ রকম বহু প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানাবিধ অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান রয়েছে। কোনো যোগ্যতা বিচার না করেই অনেক সময় আত্মীয়তা কিংবা নিজের খাতিরের লোক বিবেচনায় অনেক প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে দেখা যায়। ওইসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নজির লক্ষ্য করা যায় না। অথচ সরকার কিংবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আন্তরিক উদ্যোগ নিলেই যে নিয়োগের বিষয়ে স্বচ্ছতার পরিবেশ তৈরি করা যায়, তার দু-একটি নজির আমরা সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করেছি।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ১০৩ টাকার আবেদনে পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগের বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে। এমনকি নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে পুলিশকে। এসব বিষয়ে সাধারণ জনগণ এবং অনেক ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীরা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। কারণ বেশ কিছুদিন থেকে মানুষের মনে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, আর্থিক লেনদেন ছাড়া কোনো সরকারি চাকরি হয় না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই একটি নিয়োগ সিন্ডিকেট কাজ করে, যারা আর্থিক লেনদেন কিংবা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। শুধু পুলিশের চাকরি নয়, অন্য যে কোনো চাকরির বিষয়ে এ বিষয়টি অনেকটা 'ওপেন সিক্রেট'।
তত্ত্বগতভাবে এটি পরিস্কার যে, নিয়োগে স্বচ্ছতা আনয়নের বিষয়টি সুশাসনের অন্যতম একটি উপাদান। বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের অনেক অগ্রযাত্রা থাকলেও নিয়োগ বাণিজ্য প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। সরকার যদি প্রকৃতপক্ষে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে নিয়োগের ক্ষেত্রে কীভাবে স্বচ্ছতা আনা যায়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বারবার হুঁশিয়ারি থাকা সত্ত্বেও সেগুলো যথাযযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না প্রতিটি ক্ষেত্রে।
২০১৮ সালে এই পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের পরিস্থিতিটা ছিল ভয়াবহ। সেখান থেকে উতরে একটি দৃষ্টান্তমূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্ভব হয়েছে নিঃসন্দেহে সংশ্নিষ্টদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়। গত বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর দু'দিন আগে ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া হঠাৎ করেই স্থগিত করা হয়। একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে নিয়োগটি স্থগিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও পাঠানো হয়েছিল। ওই সময়ের বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, 'পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। বিভিন্ন জেলায় রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে এমপি-মন্ত্রীরা পুলিশ সুপারদের কাছে তালিকা ধরিয়ে দেন। একজন কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলাভেদে ৭ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। ফলে ওই নিয়োগটি স্থগিত হয়।'
সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ বছরের কনস্টেবল নিয়োগে আইজিপি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গত ২২ জুন থেকে সারাদেশে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ শুরু হয়। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, পূর্ববর্তী সময়ে পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি এমনভাবে প্রচলিত হয়েছে যে, এবার লেনদেন না করার জন্য মাইকিং পর্যন্ত করতে হয়েছে। এ থেকে পরিস্কার ধারণা করা যায় যে, আগের নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই অর্থ লেনদেন করে সম্পন্ন হয়েছে। কাজেই পুলিশের পক্ষ থেকে একটি সুষ্ঠু তদন্ত করে পূর্ববর্তী এসব নিয়োগ বাণিজ্যের হোতাদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থ্ গ্রহণ করা।
এবার কোনো রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক নেতা, পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রীরাও সুপারিশ করেননি। ফলে সাধারণ কোটায় সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে ১০৩ টাকার ফরম পূরণ করে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে। বাংলাদেশে চাকরির বাজারে আর্থিক লেনদেনের ইস্যুটি বিগত প্রায় তিন দশক ধরে আমাদের সামনে এসেছে। মেধাবীদের একটি অংশ কোনো রকম আর্থিক লেনদেন ছাড়া যেমন চাকরি পায়, ঠিক তেমনি অনেকেই আর্থিক লেনদেন কিংবা বিশেষ যোগাযোগ ছাড়া চাকরি পাওয়ার বিষয়টি ভাবতেও পারে না। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে যেসব নিয়োগ কার্যক্রম সম্পাদিত হয়, সেগুলোতে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ ছাড়া চাকরি পাওয়া কঠিন। এ কারণে বর্তমানে এ দেশের মানুষের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, অর্থ লেনদেন ছাড়া চাকরি নামের সোনার হরিণটি কিছুতেই হাতে পাওয়া সম্ভব নয়। দায়িত্বশীল অসাধুদের আত্মীয়-স্বজন অথবা পরিবারের কোনো অসৎ ব্যক্তির মাধ্যমে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পথ মাঝেমধ্যেই খোলা পাওয়া যায় বলে জানা যায়। দেশের মেধাবী সন্তানরা নিজের যোগ্যতায় যখন চাকরি নামের সোনার হরিণ পেতে ব্যর্থ হয়, তখনই ওইসব প্রতারকচক্রের প্রতারণার শিকার হয়। যার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ ও নির্মম। তাছাড়া যদি সত্যিই এ ধরনের কোনো বাজারে এসব মেধাবী সন্তান অর্থের বিনিময়ে চাকরি নামের সোনার হরিণটি কিনতে পায়, তার ফলাফলই-বা কেমন হতে পারে, তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি?
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়