ক’বছর আগে সকাল আটটা-দুপুর দুটা পর্যন্ত বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরজা খোলা থাকত সপ্তাহে ছয় দিন। সময়ের পরিবর্তনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরজা সপ্তাহে পাঁচ দিন নয়টা-পাঁচটা খোলার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এটা অনেকের কাছে আরও ভালো ঠেকেছে।সোমবার (২ মার্চ) যুগান্তর পক্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, কারণ সারা পৃথিবীতে খোলা দুয়ার নীতি প্রচলিত হওয়ায় তার সুফল বেশি করে পাওয়ার জন্য এটা একটা আধুনিক প্রচেষ্টা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এত বড় স্থাপনা, এতশত কক্ষ, গবেষণাগার সন্ধ্যা নামলে বন্ধ হয়ে ভুতুড়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে, তা মেনে নেয়া যায় না।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরজা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকবে, ক্লাস-পরীক্ষা হবে, গবেষণা হবে- এটাই তো সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন: সান্ধ্য কোর্স বিষয়ে ইউজিসি ব্যবস্থা নিতে পারে: প্রধানমন্ত্রী
সান্ধ্য কোর্স চালু রাখা এই সময়ের দাবি
ঢাবির সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে না বলায় শিক্ষকদের তোপের মুখে মাকসুদ কামাল
সান্ধ্য কোর্স বন্ধের সুপারিশ : ভর্তি বিজ্ঞপ্তির হিড়িক
সান্ধ্য কোর্স রাখতে ঢাবি শিক্ষকদের একাংশ ‘ফাইট’ দেবেন
এ নিরিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন এমবিএ কোর্স চালু করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ইন্সটিটিউট ও বিভাগে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। যারা অর্থ ও সুযোগের অভাবে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তারাই মূলত সান্ধ্য মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান হওয়ায় এবং তাদের নীতিমালায় ব্যাপক নমনীয়তা থাকায় অবস্থার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক অনৈতিকতা এসে এ উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় ধস তৈরি করে ফেলেছে এবং একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে নানা পেশার নানা বয়সের শিক্ষার্থীরা এসব অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করে অতি সহজেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার সুবিধা গ্রহণ করছেন। কিন্তু অনেক ভুঁইফোড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা তাদের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বহু জালিয়াতচক্র ঘাটেমাঠে সার্টিফিকেট ছড়িয়ে দিলে একটা নাজুক অবস্থা তৈরি হয়ে যায়।
বিশেষ করে বিভিন্ন চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে কিছু ভুঁইফোড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দামি ফলাফলের সার্টিফিকেট দেখে অবাক হতে হয়। ভাইভা বোর্ডে তাদের সার্টিফিকেটের ওজন অনুযায়ী প্রশ্ন করলে উত্তর না পেয়ে এক সময় সেগুলো ভুয়া প্রমাণিত হতে থাকে ও তারা চাকরি লাভে ব্যর্থ হতে থাকে।
অন্যদিকে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ ‘সম্মানীতে’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে শিক্ষকতায় আকর্ষণ করতে থাকলে তারা নানা সমালোচনার সম্মুখীন হতে থাকেন বিধায় মর্যাদা রক্ষার তাগিদে এক সময় তাদের এ আকর্ষণ কমে যায়।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এক সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিলে অনেক বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের অনুমতি সাপেক্ষে সাড়ম্বরে চালু হতে থাকে সান্ধ্য কোর্সে। এভাবে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স খুলে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করে দেন। এতে দুটো বড় বিষয় ফুটে ওঠে। একটি হল- বড় নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন বন্ধ হওয়া। দ্বিতীয়টা শিক্ষার্থীরা নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট অর্জন করবেন, সেই আশা পরিপূর্ণ হওয়া।
এভাবে ক্রমান্বয়ে দেশের সব বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স চালু হয়ে গেছে। অনেকে এ কোর্সের নিয়ন্ত্রণহীনতা, ক্যাম্পাসের পরিবেশ ও উচ্চ ফি গ্রহণ বা শিক্ষা বাণিজ্যের কথা বলে এর বিরোধিতা করছেন। কিন্তু রাজধানীর বাইরে অনেক বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ফি গ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এ ছাড়া ফ্যাকাল্টি কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেলের (এফকিউএসি) মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করে এসব সমস্যা খুব সহজেই সমাধানযোগ্য বলে অনেকে মনে করেন। সন্ধ্যা বেলায় নীরব, নিস্তব্ধ, ভুতুড়ে ক্যাম্পাসে সুদৃশ্য আলো জ্বালানোর মাধ্যমে অতীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারা উচ্চশিক্ষাবঞ্চিত বয়স্ক, পেশাদার কিছু মানুষ যদি নতুন করে জ্ঞানের অন্বেষণে আগ্রহী হতে আসেন, তবে তাদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা কি ভালো ঠেকে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের যুগে এসে প্রাকৃতিক জ্ঞান ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এসব প্রতিভাকে আমাদের সাদরে শিক্ষার সুযোগ দেয়া উচিত। শিক্ষা সম্প্রসারণের আধুনিক ধ্যান-ধারণায় উচ্চশিক্ষাবঞ্চিত সব বয়সী মানুষের দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগমতো যে কোনো সময় শিক্ষা লাভের অধিকার রয়েছে। অনেকে বলেন, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সব মানুষের মৌলিক অধিকার নয়। হ্যাঁ, তবে যার যখন যে বয়সে যেভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতা ও সুযোগ তৈরি হবে- তাদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা মোটেও উচিত নয়।
একাডেমিক কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ না করে হঠাৎ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সান্ধ্য মাস্টার্স প্রোগ্রাম বন্ধ করার জন্য তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে। এ জন্য যে বিষয়টি আমার কাছেও নেতিবাচক তা হল সাধারণ দিবাকালীন কোর্সের তুলনায় বর্ধিত কোর্স ফি গ্রহণ। সে জন্য কোর্স ফি স্বল্পহারে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। দেশে স্বল্প খরচে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের আগ্রহ ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। ফি বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করা বিপুলসংখ্যক ভর্তিচ্ছুর এ চাহিদা পূরণ ও চাপ নিরসনে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় শিফট অনার্সও চালু করা যেতে পারে বলে মনে হয়।
তাই সান্ধ্যকোর্স নিয়ে হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। বরং, এ কাজ করতে গেলে যা ঘটতে পারে তা হল- এতে ভুঁইফোড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মহাখুশি হবে। তাদের ব্যবসা আরও ফুলেফেঁপে উঠবে। তারা রাজধানীসহ সব বড় শহরে আরও শাখা খুলে আরও বেশি যানজট, মানুষজট তৈরি করবে। দেশের সব বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য মাস্টার্স প্রোগ্রাম বন্ধ হলে সেখানকার নামকরা পণ্ডিতরা আবার দামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ ‘সম্মানীতে’ পাঠদানে রত হতে পারেন।
আমাদের দেশে প্রতিবছর অনার্স লেভেলে শুধু উপযুক্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে ভর্তি হতে না পেরে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়। কারণ অনেক অভিভাবকের সামর্থ্য নেই লাখ লাখ টাকা খরচ করে দামি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের ভর্তি করানোর। এ সমস্যা দূর করতে আমাদের দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যবাতি জ্বালিয়ে রাখার সময় এসেছে। যদি আমরা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স লেভেলে দ্বিতীয় শিফট চালু করি তাহলে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করা ওয়েটিং লিস্টে যে হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী থাকে ও হতাশার প্রহর গুনে দিন কাটায়, তাদের ভর্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব।
এদের অভিভাবকদের মুখে তথা দেশের ভবিষ্যৎ স্বপ্নধারীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান সম্ভব। এ জন্য অতিরিক্ত কিছু যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও ওভারটাইম দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেতে পারে। দেশে এখন উচ্চশিক্ষিত বেকার অনেক। সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত, এমফিল-পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের বেকার সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারে।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান