নীরস শিক্ষাব্যবস্থাপনার নিরসন হোক - Dainikshiksha

নীরস শিক্ষাব্যবস্থাপনার নিরসন হোক

রব নেওয়াজ খোকন |

আমি শিক্ষকতা পেশার একযুগ পূর্ণ করেছি। কথাটা গর্ব করে বলছি না। এটি আদৌ কোনো গর্বের পেশা নয়। এ-পেশায় রুজি-রোজগারের পরিমাণটা উঁচুগলায় জানান দেবার মতো নয়। মোটা চালের ভাত আর মোটা কাপড় পরার উদাহরণ এ-পেশার লোকদের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকে। সবচে বেশিক্ষণ দর-দাম করে পণ্যকেনা বা বাজার করার উদাহরণ সম্ভবত এ-পেশার লোকদের মধ্যেই বেশি। রিকশা কিংবা গাড়িতে না চড়ে, পায়ে হেঁটে স্বল্পবিস্তর রাস্তা পাড়ি দেয়া, ছেলে-মেয়েদের নিত্য-নতুন দামি ফল-ফলাদি কিনে দেবার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে মাস পার করে দেয়া, এসবও কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। অন্য কোনো দেশের কথা বলছি না। বলছি বাংলাদেশের শিক্ষকদের কথা। তবে এটাও স্বীকার করছি, ক্ষেত্রবিশেষে আমার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত উদাহরণও রয়েছে। শিক্ষকতা করে বাড়ি-গাড়ি করার উদাহরণও এদেশে কম নয়। দুধে পানি মিশিয়ে অধিক মুনাফালোটা ব্যবসায়ীদের মতো শিক্ষকও এদেশে রয়েছে। টাকাঅলা অভিভাবকদের ছেলে-মেয়ে পড়ানোর নাম করে, লাখো-কোটি টাকা হাতিয়ে নেবার প্রতিষ্ঠানও এ-দেশে রয়েছে। তবে সংখ্যায় এরা খুব বেশি নয়। দারিদ্র্যপীড়িতের সংখ্যাটাই বড়। এ বিষয়ে  একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনার যথার্থতা প্রমাণের উদ্দেশ্যেই এ-পেশার সাথে দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ টেনেছি।

একযুগের অভিজ্ঞতা থেকে জানলাম, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অকৃতকার্যতার পেছনে কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে। সেসব কারণ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষাবিদ আলোচনা করে এসেছেন। এর মধ্যে একটি হলো বিনোদনহীন নীরস শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বা পাঠদান পদ্ধতি। আমি এ-সম্পর্কে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে নিজের মতটাই তুলে ধরছি। 

গণহারে শিক্ষার্থী ফেলের মূলে এ কারণটিই সবচে' বেশি দায়ী। আসলে এটাই হলো মূল কারণ। দুর্বল ও অযৌক্তিক ব্যবস্থাপনার কারণে শিশু-কিশোররা পাঠবিমুখ হয়। এরা বড়দের তুলনায় অনেক বেশি বিনোদনপ্রিয় হবার কারণে, বইয়ের গুদাম থেকে বেরিয়ে খেলার মাঠে ফুটবল কিংবা ক্রিকেটব্যাট নিয়ে দৌড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। পাখির বাসা থেকে ছানাধরা, বাড়ির পাশের জলাশয়ে বড়শি ফেলে মাছধরা, পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটা প্রভৃতি কাজে এদের আনন্দ বেশি। তাদের কাছে বইয়ের গুদাম মানে জ্ঞানেরের গুদাম। কিন্তু বইয়ের পাতা থেকে গুরুমুখী বিদ্যা বা জ্ঞান আহরণের চেয়ে, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর ঘুরে বাস্তব জ্ঞান আহরণে ওদের আকর্ষণ বহুগুণ বেশি। কারণ তাতে রয়েছে অপার স্বাধীনতার সুখ, পছন্দ-অপছন্দের ঐচ্ছিক মূল্যবোধ, ভালোলাগার প্রাকৃতিক বার্তা। আর সে আকর্ষণের গতি আরো বেশি ত্বরান্বিত হয়; যখন এদের বেত কিংবা লাঠি নিয়ে ধাওয়া করা হয়। কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করানো বা মাঠ প্রদক্ষিণ করানো হয়। এসব মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে বিষয়টি আরো বেশি বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। শাস্তি বা হুমকি-ধামকি দিয়ে গোটাকয়েক প্রশ্নোত্তর শেখানো হলেও এর স্থায়িত্বকাল বিজলি চমকানোর মতোই ক্ষণস্থায়ী। তাছাড়া এ-শেখা তোতা-ময়না পাখির মতোই অসার-অধ্যয়ন। বড়জোর একসপ্তাহের জন্য মগজে ঠাঁই। তারপর মনের অজান্তেই হাওয়া। যে অর্জনে আন্তরিকতা নেই, তার স্থায়িত্বকাল অল্প হওয়াই স্বাভাবিক। এ প্রক্রিয়ার বিদ্যার্জন আন্তরিকতাশূন্য সম্পর্কের মতোই স্বল্পমেয়াদি।

বাঙালি জাতির বিদ্যার্জনের সূচনালগ্ন থেকেই শাস্তিপ্রথার প্রচলন। পরবর্তীতে আধুনিক বিশ্বের অনুসরণে এ ভুল প্রথাটি উচ্ছেদের জন্য সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ বিকৃত, অযৌক্তিক রীতিটি সহজে আমাদের ঘাড় থেকে নামছে না। আমরা গোঁড়াবাদীরা এ অপসংস্কৃতি অপসারণের উদ্যোগকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। সরকারি নির্দেশনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেদের মতো চালিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা আর হাসি-আনন্দ দিয়ে যে জ্ঞানচর্চার কাজটি করানোর কথা, তা করে যাচ্ছি হালের বলদের মতো লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে।  

শিক্ষক ও অভিভাবকগণকে এ ধরণের অযৌক্তিক পন্থা পরিহার করতে হবে। কৌশল ও চতুরতার সাথে ওদের মননের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বল-ব্যাট ও প্রাকৃতিক বিনোদন ব্যবস্থার চেয়েও রসালো কোনো বিনোদন যোগ করতে হবে অধ্যয়ন ব্যবস্থার সাথে। ঠিক তখনই আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কের সূত্রপাত হবে বইয়ের সাথে। দলে দলে ছুটে আসবে ওরা বইয়ের টেবিলে। 

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, বেগম রোকেয়া প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুল, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

 

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0085439682006836