এ মাসের শুরুতে তথা ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে এক কলঙ্কযুক্ত ইতিহাস রচিত হলো। এ কলঙ্কের শুরু অধ্যক্ষ কর্তৃক ছাত্রীর যৌন নিপীড়ন দিয়ে আর শেষ তাকে পুড়িয়ে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এই পাষন্ড হত্যাকান্ড দেশবাসীর মনে মারাত্মক ক্ষত তৈরি করেছে। ফলে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিনিয়ত অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে চলছে বিক্ষোভ-মিছিল, সভা-সমাবেশসহ মানববন্ধন। এসব বিক্ষোভ ও মানববন্ধন থেকে কেবল অধ্যক্ষ সিরাজসহ তার দোসরদের বিচার প্রার্থনা করছে না বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার ও নিশ্চয়তা চাওয়া হচ্ছে। এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে অধ্যক্ষ সিরাজসহ তার সাহায্যকারীদের যে বিচারই হোক না কেন এর পরে কি আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারব যে এ ধরনের অনৈতিক ও জঘন্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভবিষ্যতে আর ঘটবে না? পারব না কেননা, শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে যতই আইন আর নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক না কেন তাতে এসব অপরাধ সাময়িকের জন্য কিছুটা হ্রাস পেতে পারে কিন্তু বন্ধ করা যায় না।
আমরা স্পষ্টই বলতে পারি যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু সেকেলে নিয়ম-নীতি সিরাজসহ শামীমদের এসব কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যেমন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থাকা পরিচালনা পর্ষদ আইন এবং নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব কেন্দ্র স্থাপন করে নিজস্ব কেন্দ্র সচিবসহ কেন্দ্র পরিচালনা কমিটি করার অপরিপক্ব বিধিটি নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার জন্য সিরাজ গংদের পুরোপুরি সহায়তা করেছে। অর্থাৎ, এ জঘন্যতম ঘটনাটির জন্য সিরাজসহ তার গংদের যত দোষ তার চাইতেও ঢেরগুণ বেশি দোষ আমাদের অপরিপক্ব শিক্ষা ব্যবস্থাপনার।
কেননা, আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ মাদরাসার প্রায় ৯৪ শতাংশই এমপিওভুক্ত আর এ এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কিংবা দেখভালের দায়িত্ব থাকে পরিচালনা পর্ষদ নামে একটি গোষ্ঠীর কাছে। এ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি থেকে শুরু করে সদস্য সবাই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা হয়ে থাকে। আর এসব পরিচালনা পর্ষদ অধ্যক্ষকে তাদের অনুগত বানিয়ে, কিংবা চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে তাকে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুরো শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন যেন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো তাদের শিক্ষা দপ্তর, যেখানে অধ্যক্ষ এ দপ্তরের সেক্রেটারি, ছাত্ররা তাদের সাধারণ কর্র্মী ও ছাত্রীরা তাদের মনোরঞ্জনের বস্তু! সুতরাং তারা তাদের অনুগত অধ্যক্ষ কিংবা প্রধান শিক্ষককে যা বলবে তারা কেবল তাই করবে এবং অধ্যক্ষও যা করতে চাইবে পরিচালনা পর্ষদও তাই করতে অনুমতি দেবে যদি তা সাত খুন হয় তবুও মাফের নিশ্চয়তা। এই যদি হয় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ইতিবৃত্ত তবে আমাদের দেশে সিরাজের মতো লোকদের এহেন কর্মকান্ড অস্বাভাবিক কিংবা হতাশ করার মতো কি?
পৃর্ব থেকেই শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার দরুণ ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে। কেননা পরিচালনা পর্ষদের দ্বারা অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ যেকোন ধরাকে সরাজ্ঞান করতে পারে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেকোন আইনকে পরিবর্তন করতে পারে। যেকোন অবৈধকে বৈধ ও বৈধকে অবৈধ করতে পারে- সাথে প্রতিষ্ঠানের অর্থ ইচ্ছামতো খরচের বৈধতা রয়েছে। আর এ পরিচালনা পর্ষদকে হাতে রেখে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা যেকোন অনৈতিক কিংবা অপরাধমূলক কাজ করেও ছাড় পেয়ে যাওয়ার বহু নজির আছে। একইভাবে, দলীয় পরিচয় কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অধ্যক্ষকে বাধ্য করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমপি-মন্ত্রী, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা কিংবা চেয়ারম্যানের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ফুল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকা খরচ করে এসব নেতাদের সংবর্ধনার আয়োজন করা কিংবা এসব স্থানীয় নেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের দিয়ে নাচ-গান কিংবা মিছিল-সমাবেশে যাওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা এবং দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা ওপেন সিক্রেট এবং এসব ঘটনা কখনও কখনও আমাদের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়ে থাকে।
সবচাইতে বড় কথা হলো- এসব কর্মকান্ড কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা করেনি বরং এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা শিক্ষকরাই করেছে। কারণ এসব শিক্ষকের চাকরি এসব নেতাদের হাতে। সুতরাং এসব নেতাকে যত বেশি খুশি করা যাবে তার কিংবা তাদের চাকরি তত বেশি স্থায়ী হবে। সাথে যেকোন অনৈতিক কাজ করে ছাড় পাওয়ার নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে। সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ সরকারিভাবে হলেও চাকরি থেকে বহিষ্কার করার দায়িত্ব কিন্তু এখনও পরিচালনা পর্ষদের হাতেই রয়ে গেছে! ফলে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানপ্রধান নৈতিকতা সম্পন্ন থাকলেও চাকরি হারানোর ভয়ে তারাও এসব নেতাদের যেকোন যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক দাবি মানতে বাধ্য হয়। নুসরাত হত্যার বিষয় থেকে অনুমান করা যায় যে সারাদেশের শিক্ষকরা পরিচালনা পর্ষদ ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে কেমন জিম্মি? পরিচালনা পর্ষদের সাথে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সম্পর্ক কেমন এবং প্রতিষ্ঠানের টাকা ইচ্ছামতো কিভাবে খরচ করে পুরো প্রশাসনকে বশে আনতে পারে- তা নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার জন্য অধ্যক্ষ সিরাজের সাথে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কাউন্সিলর, থানার ওসি প্রভৃতির সম্পৃক্ততা ও গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানে এতজন শিক্ষক-কর্মচারী থাকলেও কোন শিক্ষক কেন সিরাজের এহেন অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করল না- এ প্রশ্ন আসাটা যেমন অস্বাভাবিক নয়, তেমনি চাকরি হারানোর ভয়ে বাকি শিক্ষকদের মুখ বুজে সহ্য করাটাও অমূলক নয়।
এমন একটা সময় ছিল যখন সরকারের ব্যর্থতায় গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে এলাকার শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করত এবং সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য এলাকা থেকে ধান-চাল কিংবা বিত্তশালীদের থেকে টাকান্ডপয়সা তুলে এসব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করত। কিন্তু এখন এসব এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের শতভাগ বেতন সরকার বহন করছে; তবুও কেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বের ভার পরিচালনা পর্ষদ নামে শক্তিমানের কাছে? অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা এটাই প্রথম নয় বরং বহুবার সে একই ধরনের কাজ করে কেবল পরিচালনা পর্ষদকে বস মানিয়ে ছাড় পেয়ে যায়। এ ধরনের অনেক হত্যাকান্ডের ঘটনাই আমাদের দেশে ঘটে কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের সাথে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের লেজুড়বৃত্তিক সম্পর্ক থাকার কারণে এসব হত্যাকান্ডের ঘটনা প্রায়শই ধাপাচাপা পড়ে যায়। এক সময়ের সবচাইতে শ্রদ্ধার পাত্র শিক্ষক সমাজ আজ পরিচালনা পর্ষদের কাছে চাকরি হারানোর ভয়ে সবচাইতে অবহেলিত ও নিরীহ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকরা যদি অন্যায়, অনৈতিকতার প্রতিবাদ করার সাহস না রাখে তবে আমাদের সন্তানদের তারা কিভাবে অন্যায়, অনৈতিকতার প্রতিবাদ করাতে শিখাবে? সুতরাং এখনই সময় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে এ অদ্ভুত ব্যবস্থাপনার বিলুপ্তি ঘটানো। জাতীয়করণে সময় লাগলে সেক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ আইনটি বাতিল করে সরকারি কলেজসমূহ যেভাবে পরিচালিত হয় সেভাবে পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া।
নুসরাতকে এভাবে পরীক্ষার কেন্দ্রে পুড়িয়ে মারার কাজটা অনেকটা সহজ করে দিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্র পরিচালনা পদ্ধতি। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি সাংঘাতিক ত্রুটি হলো- নিজ প্রতিষ্ঠানে বোর্ড পরীক্ষার কেন্দ্র হওয়া। একবার ভাবা যায়- যদি উক্ত মাদরাসার পরীক্ষা কেন্দ্রটি অন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হতো কিংবা এ কেন্দ্রটি পরিচালনার ভার অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হাতে থাকত, তবে কি নুসরাতের গায়ে এভাবে আগুন দেয়ার সাহস পেত? গেট পাহারা, হোস্টেলে বসে মিটিং, পুলিশ সদস্যদের বশে আনা এসব কি সম্ভব হতো?
পরীক্ষা ব্যবস্থা এতটাই ত্রুটিপূর্ণ যে, নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব কেন্দ্রের ব্যবস্থা করে আবার সেই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ কেন্দ্র কমিটি গঠিত হয় ওই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষকদের দিয়ে! ফলে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন কিংবা অনৈতিক সহযোগিতা করে শিক্ষার্থীদের পাস করানোর হাজার নজির সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে পরীক্ষার কেন্দ্রে একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সদস্য হওয়ায় তারা পরীক্ষা শুরুর ৪০ মিনিট ক্ষেত্রবিশেষে ২ ঘণ্টা আগেই প্রশ্নপত্র হাতে পায় আর এ সুযোগে নুসরাতকে অধ্যক্ষ সিরাজ কর্তৃক অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয় এবং এর বিনিময়ে বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেয়া হয়!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ কিংবা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র নির্যাতন কিংবা ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং এসব ধাপাচাপা দেয়ার মূল শক্তিকে মূলোৎপাটন করতে না পারলে এহেন ঘৃণ্য কর্মকান্ডের শেষ এখানেই নয় বরং সামনে আরও ভিন্নরূপে ফিরে আসবে। সুতরাং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই উপরোক্ত দুটি বিধি পরিবর্তন করতে হবে। যদিও আগামীতে প্রতি উপজেলায় স্বতন্ত্র পরীক্ষা ভবন তৈরি করার পরিকল্পনা রযেছে সরকারের; কিন্তু তার আগে বর্তমানে প্রচলিত পরীক্ষা কেন্দ্র বিধি পরিবর্তন করে অন্যভাবে পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য গঠিত পরিচালনা পর্ষদ বিধিটি একেবারে পরিবর্তন করে সেখানে ডিসি, এডিসি, ইউএনও, বিচারক থেকে একজনকে নয় বরং চারজনকেই সম্পৃক্ত করে পরিচালনা পর্ষদ বিধি পরিবর্তন করতে হবে। তবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নুসরাতরা শান্তিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে এবং অন্য শিক্ষকরাও তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও নীতি বিশ্লেষক
সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ