সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বাড়ছে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিশুধর্ষণ ও হত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও। এক ঘটনার জের শেষ না হতেই নতুন করে দুঃখজনক ঘটনার অবতারণা হচ্ছে। সম্প্রতি বরগুনায় রিফাত শরীফকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর ওয়ারীতে ৭ বছরের শিশু সায়মা আফরিন সামিয়া ধর্ষণ ও হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। নারীত্বের বিকাশহীন অবুঝ শিশুর প্রতি এমন নৃশংসতা প্রমাণ করে আমাদের অবক্ষয়ের স্তর কত নিচে নেমে গেছে। আমাদের দেশে ধর্ষণসহ অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলেছে। আইনের ত্রুটি, প্রায়োগিক জটিলতা, এ জন্য প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মহলবিশেষে অপরাধ ও অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দান, অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রভাব; আশ্রয়-প্রশ্রয়, এ জন্য প্রধানত দায়ী। তবে সরকার অবশ্য এ ব্যাপারে খুবই কঠোর। তবু থামছে না শিশু ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা। দেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতাসহ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা যে এখন নিয়ন্ত্রণহীন তা সর্বসাম্প্রতিক অপরাধপ্রবণতা পর্যালোচনা করলেই উপলব্ধি করা যায়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন নৌশিন নাওয়াল সুনম।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মূল্যবোধের অনুপস্থিতি ও বাঁধভাঙা অক্ষয়ের কারণেই অপরাধপ্রবণতাও লাগামহীন। নারী ও শিশুধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা এর একটি অনুষঙ্গ মাত্র। ধর্ষণ অভিনব কোনো অপরাধ নয় বরং সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আর তা দমন, নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত পরিসরে রাখতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই অপরাধকে দণ্ডবিধির আওতায় আনা হয়েছে। বিভিন্নভাবে এই অপরাধকে সংজ্ঞায়ন ও অপরাধের ধরন মোতাবেক দণ্ডবিধিতে শাস্তির ধরনও বিধৃত হয়েছে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা হলো ধর্ষণবিষয়ক ধারা। এ বিষয়ে আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনও রয়েছে। দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। ধর্ষণজনিত কারণে ভিকটিমের মৃত্যু হলে প্রাণদণ্ডের বিধানও রয়েছে আইনে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের দেশে ধর্ষণবিষয়ক আইন বেশ সময়োপযোগী বলেই মনে করা যায়; কিন্তু আইনের শাসনের দীর্ঘসূত্রিতার জন্যই এই অপরাধ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়ও এ জন্য কম দায়ী নয়। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সব কিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে সুশাসনের অভাব, ধর্মবিমুখতা, অসহিষ্ণুতা এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরো কিছু বিষয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধই মানুষের জীবনপ্রণালি ইতরপ্রাণী থেকে আলাদা করে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত রূপ দেয়। পক্ষান্তরে ধর্মহীনতা মানুষকে নামিয়ে দেয় পশুত্বেরও নিম্ন পর্যায়ে। তাই দেশকে নারী ও শিশুধর্ষণের ভয়াবহতা রোধসহ অপরাধপ্রবণতা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, দণ্ডবিধির যথাযথ প্রয়োগ, নৈতিক শিক্ষার সম্প্রসারণ সর্বোপরি সর্বসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রতকরণের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র ধর্মীয় মূল্যবোধই পারে আমাদের এই ভয়াবহ অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে। মূলত প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠন, অবক্ষয়হীন ও অপরাধমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্প্রসারণ, লালন ও অনুশীলন করতে হবে। অন্যথায় সামিয়াদের ভাগ্যবিড়ম্বনার অবসান হবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।