পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতীক - দৈনিকশিক্ষা

পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতীক

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চলে গেলেন কুঁড়েঘরের মোজাফফর আহমদ। আমাদের কুমিল্লার মানুষের কাছে তিনি এই নামেই পরিচিত। ‘আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর’- এ স্লোগান একসময় মুখরিত ছিল আমাদের অঞ্চলে।

তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি। ২৩ আগস্ট রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে পাকিস্তান শাসনামল শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বচ্ছ রাজনীতির দৃষ্টান্ত তিনি। প্রায় শতবর্ষী বৃক্ষের মতো ছিলেন তিনি। বৃক্ষের মতোই তার ছায়া পেয়েছে জাতি। শনিবার (৩১ আগস্ট) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া।

তার চলে যাওয়া প্রাজ্ঞ, সৎ, নির্লোভ, দায়িত্বশীল একজন উঁচুমাপের রাজনীতিকের চিরবিদায়। শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও কালে কালে কমরেড মোজাফফর আহমদ হিসেবেই দেশে তার একটি শ্রদ্ধাপূর্ণ আসন স্থায়ী হয়ে উঠেছিল। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের বাম রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

১৯৩৭ সালে ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি কমরেড মোজাফফরের। ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন তার প্রেরণা। কৈশোরে কুমিল্লার চান্দিনায় গান্ধীজি আসবেন শুনে বাড়ি থেকে হেঁটে ওদিকে যাত্রা করেন। পথেই জানতে পারেন গান্ধী এসেছিলেন আর বলে গেছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান এক হও, ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে খেদাও।’ গান্ধী বক্তব্য দেননি, বাণী দিয়েছেন। এই বাণীই কমরেড মোজাফফরকে প্রাণিত করে।

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে তিনি এর কেন্দ্রীয় নেতা হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তৎকালীন সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। তখন তার মাথার দাম হাঁকা হয়েছিল। আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। পরের বছরই ন্যাপ বিভক্ত হলে মস্কোপন্থী অংশের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব নেন তিনি। পরে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অবস্থান নেন।

তিনি ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি পুরোপুরিভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সেবার যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে কুমিল্লার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের জাঁদরেল প্রার্থী মফিজউদ্দিনকে বিপুল ভোটে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৫৭ সালের এপ্রিলে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান মোজফফর আহমদের প্রস্তাবের পক্ষে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেন। পরে প্রস্তাবটি পাসও হয়েছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতৃত্বের একজন এবং প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। সে সময় স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন। এ সময় তিনি জাতিসংঘেও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠনে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতন দেখেছেন তিনি। লড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে; কিন্তু রাজনীতির ফায়দা অন্য অনেকের মতো লুফে নেননি তিনি। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু কিংবা লোভনীয় টোপ গেলাতে পারেনি তাকে। সে কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলে তিনি ন্যাপ, সিপিবি এবং প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে মোজাফফর আহমদ কারারুদ্ধ হন।

তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপ্তি তেমন একটা দৃঢ় ছিল না। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন আগরতলায় বেশকিছু দিন আমার এবং আমার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ’৭১-এর এপ্রিল মাসের কথা, আমরা কুমিড়ার যুদ্ধ শেষ করে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাকবাহিনীর আক্রমণের পর রামগড়ে পিছু হটি।

একপর্যায়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আমার স্ত্রীকে কৌশলে বের করে এনে তাকে নিয়ে আগরতলায় চলে যাই। আমার স্ত্রী নার্গিস তখন সন্তানসম্ভবা। প্রথমে সাংবাদিক অনিল বাবুর সহায়তায় আমরা জেলা জজ এসএম আলীর বাড়িতে উঠি। কয়েকদিন পর এসএম আলীর সহায়তায় আমরা আগরতলা এমএলএ হোস্টেলের একটি কক্ষে উঠি। সেখানেই প্রথম দেখা হয় মোজাফফর আহমদের সঙ্গে। সে সময় আমাদের বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের বেশিরভাগ নেতাই আগরতলায় ছিলেন।

বিশেষ করে মোজাফফর আহমদ, মালেক উকিল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, রশিদ ইঞ্জিনিয়ার, আহমদ আলীসহ বহু নেতা। আমি রণাঙ্গন থেকে মাঝে মধ্যে কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে স্ত্রীকে দেখতে আসতাম। মোজাফফর সাহেব কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। দেখা হলেই তিনি রণাঙ্গনের ঘটনা শুনতে চাইতেন। একদিন কুমিড়ার যুদ্ধের ঘটনা শুনে তো অবাক হয়ে যান। একটি প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধজয় তাকে বিস্মিত করে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিন দিন কী করেছিলাম তার বর্ণনাও তিনি আমার মুখে শুনেছিলেন। নার্গিসকে তিনি বৌমা বলে ডাকতেন। তার খোঁজখবর নিতেন। দেশ স্বাধীনের পর তার সঙ্গে আমার দু’-একবার দেখা হলেও তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। ’৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন এবং বিপুল জনসমর্থন তার পক্ষে ছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী হতে পারেননি। তার সহধর্মিণী আমিনা আহমদ দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের একজন সদস্য ছিলেন। মাঝে মধ্যে তাকে মোজাফফর সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতাম, খোঁজখবর নিতাম।

মোজাফফর আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম, তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বড় অবদান রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

২০১৫ সালে সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক দিতে চেয়েছিল। তিনি সবিনয়ে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার লিখিত বক্তব্যে যুক্তি মেলে পদক-সম্মাননা গ্রহণে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। লিখেছেন, ‘পদক নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম, কোনো পদক বা পদ-পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশা করেন না।

পদ বা পদকের জন্য কখনও রাজনীতি করিনি। রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা।’ তার এই অভিমত রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগী হতে প্রেরণা দেবে। তার সারা জীবনের রাজনীতির আদর্শ ছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, যে সমাজে থাকবে না ভেদাভেদ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে হলে সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে। মোজাফফর আহমদের পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আজকের তরুণ রাজনীতিক এবং আগামীর দেশসেবায় যারা আত্মনিয়োগ করবেন, তাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হতে পারে। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া : সংসদ সদস্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044360160827637