২১ ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম এবং একটি অমর ইতিহাস। ১৯৫২-এর পরবর্তী সময়ে বর্ষ পরিক্রমায় একুশ আসে, একুশ যায়। প্রতিবারই বাঙালির মানসচেতনা শানিত হয় তরুণদের প্রাণস্পন্দনে। আমরা যারা ’৫২-এর রক্তাক্ত স্মৃতি ধরে রেখেছি, তারা কিন্তু অনেকেই নীরব। এখন সরব আমাদের উত্তরসূরিরা। তারা জানতে চায়, আরও বুঝতে চায়।
১৯৫২ সালের সফল ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ১৯৫৬-তে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। কিন্তু উভয়াংশের মধ্যকার অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্য থেকেই যায়। এ বৈষম্য থেকেই নানা রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। এ স্বাধীন রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাই একুশ পালনেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। শুরু হয় মাত্র। দীর্ঘকাল প্রচলিত ইংরেজির স্থলে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে গিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমস্যা নিয়ে কথা উঠেছে। আজকে আমার বক্তব্যে তারই দু-চারটা বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে।
পটভূমি : কেন বাংলা? যেহেতু বাংলাদেশে সবার বোঝার মতো, বলার মতো ভাষা বাংলা প্রচলিত, সেহেতু স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী সবার বলার ও জানার ভাষাতেই অফিস-আদালত, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি চলবে বিধায়, এটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতিরেকে বাংলা প্রচলনের কোনো বাধা আছে বলে অনেকে মনে করেন না।
প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে প্রথমে আসে অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রসঙ্গ। ইতিহাস থেকে জানি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের নির্দেশে (১৮৩৭) মোগল আমল থেকে দীর্ঘ প্রচলিত ফারসি ভাষার পরিবর্তে অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। তখন উকিল-মোক্তাররা ফারসি-বাংলা শব্দ মিশিয়ে ইংরেজি বলার চেষ্টা করেন। অবশেষে সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে এক্ষেত্রের প্রতিবন্ধকতা অনেকটা দূর হয়ে যায়।
সম্প্রতি হাইকোর্টের কিছুসংখ্যক আইনজীবী লর্ড বেন্টিংকের আমলের কথা বিস্মৃত হয়েছেন বলে মনে হয়। হঠাৎ বাংলা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়াতে তাদের কারও কারও অসুবিধা হচ্ছে। আমার অভিমত হচ্ছে, একটি বিশেষ ভাষা দীর্ঘদিন প্রচলিত থাকার কারণে ছকবাঁধা কিছু শব্দ, মুসাবিদা ইত্যাদি অভ্যাস হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওই জায়গায় নতুনভাবে অন্য ভাষার প্রচলন হলে স্বভাবতই প্রাথমিক অবস্থায় সব দেশে সবকালেই কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে।
এর জন্য প্রাথমিক অবস্থায় কিছু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন আছে। আচরণদৃষ্টে বোঝা যায়, উচ্চপর্যায়ে কিছুসংখ্যক আইনজীবীর মধ্যে ত্যাগ ও কষ্ট সহিষ্ণুতার অভাব আছে। তারা যে অসুবিধাটুকুর কথা বলেছেন, তা হচ্ছে কিছু কিছু শব্দের সঠিক পরিভাষা খুঁজে না পাওয়া এবং বাংলা রীতিতে মুসাবিদা লেখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনভ্যস্ততা।
আমার অভিমত হচ্ছে- ১. সঠিক বাংলার প্রতিশব্দের অভাবে হুবহু ইংরেজি শব্দ যেমন- টার্ম, টর্ট, হেভিয়াস কর্পাস ইত্যাদি শব্দ বাংলায় লিখে ব্যবহার করা যায়। ২. বাংলা রীতিতে মুসাবিদা ইত্যাদি লেখার ব্যাপারে আইনজীবিদের নিজস্ব মেধা ও প্রতিভা থাকার প্রয়োজন। উল্লেখ্য, আইন-আদালতের ক্ষেত্রে মক্কেলদের ভাষার বাইরে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার এখনও যথার্থভাবে প্রচলিত হতে পারেনি। উচ্চপর্যায়ে যারা বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞান বিতরণ করছেন, তারা প্রায় কেউই বাংলায় তা আয়ত্ত করেননি। ফলে উচ্চপর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে গিয়ে অনুবাদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। সেই অনুবাদ মৌখিকভাবে ক্লাসে চালানো যেমন কষ্টকর, তেমনি আয়ত্ত করাটাও অনেকটা কষ্টকর।
এ রকম অবস্থায়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা বেশি শ্রম দিয়ে আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে এলে কাজটা খুব বেশি দুরূহ থাকার কথা নয়। আমরা প্রায় সবাই চাই গাছতলায় পড়ে থাকা পরিপক্ব আস্ত একটা ফল। বলা বাহুল্য, নানা কারণে বিনাশ্রমে তা লাভ করা যায় না। প্রযুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান শিক্ষার উচ্চপর্যায়ে বাংলার প্রচলন আসলেই খুবই দুরূহ কাজ। কিন্তু এটাও বিশ্বাসযোগ্য খবর যে, এসব ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিভাবান শিক্ষক আছেন, যারা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এ কাজে ব্রতী হলে বাংলার প্রচলন অপেক্ষাকৃত সহজ ও সুগম হয়ে উঠবে। অবশ্য এর জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক সরকারি প্রচেষ্টা। প্রসঙ্গত এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, খুব সম্ভবত ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমির সঙ্গে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড একীভূত করা হয়।
এর পূর্বে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বাংলা ভাষার উন্নয়নসহ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা, আইন ইত্যাদি বিষয়ক বাংলা পাঠ্যপুস্তক তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু এ বোর্ডকে বাংলা একাডেমির সঙ্গে একীভূত করার ফলে বিগত ৪৫ বছরেও বাংলা পাঠ্যপুস্তক নির্মাণ কাজ যথাযথভাবে এগোয়নি। এতে এতদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আবারও বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে আগের মতোই স্বতন্ত্র মর্যাদায় স্থাপন করা হোক এবং এভাবে আলাদা করা বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হোক। এতে অল্প সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত, বিদেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা, চাকরি ও অন্য বহু ক্ষেত্র বহুগুণ প্রসারিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ইংরেজি মূল ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এককালের পৃথিবীর সেরা ট্রেডিং নেশন জাপান, মহাশক্তিধর চীন এবং ইউরোপের ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের কথা উল্লেখ করা যায়। এরা ইংরেজিতে বাংলাদেশের মতোও এতটা পাকা নয়। বিদেশের সঙ্গে এসব দেশের যোগাযোগের পদ্ধতিটা কী? তা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ করতে পারি। মূল কথা হচ্ছে, একটা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কর্মক্ষমতা ও নিষ্ঠা সেই জাতির আসল সম্পদ। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ চীন, জাপান।
একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি, জার্মান, রাশানসহ অন্যান্য কয়েকটি বিদেশি ভাষায় যে কোনো একটি বা একাধিক ভাষা শেখার প্রয়োজন হতে পারে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য। এক্ষেত্রে শুধু উচ্চ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাই ব্রতী হন। এদের সংখ্যা বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর তুলনায় এত নগণ্য যে, চোখে পড়ে না। তদুপরি, উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে এ জাতীয় শিক্ষার্থীর পক্ষে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষার জ্ঞান আয়ত্ত করা বিশেষ কোনো সমস্যার বিষয় নয়।
চতুর্থত, প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি একটা বিশেষ শ্রেণীর গভীর ষড়যন্ত্র ও চিন্তা চেতনার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলা থেকে এবং প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয় থেকে নিজেদের বিছিন্ন করে, তাদের সন্তান-সন্তানাদিদের কিন্ডারগার্টেন ও অন্যান্য ইংরেজি মিডিয়ামের স্বতন্ত্র স্কুলে পাঠাচ্ছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এরকম শত শত স্কুল ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর অনেক আবার বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও চলছে। এ ব্যাপারে দেশের সচেতন নাগরিকরা প্রতিবাদী না হলে সর্বনাশ হতে পারে।
যাদের অন্যান্য ভাষাও জানার প্রয়োজন, তারা তা ব্যক্তিগত প্রয়াসেও শিখে নিতে পারেন। বর্তমানে ইংরেজি ছাড়াও বিদেশি ভাষা বহু তরুণ-তরুণী আয়ত্ত করছে তাদের নিজস্ব প্রয়োজনের তাগিদে। কোনো বাধা-নিষেধ নেই। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে স্বল্পসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীর বিদেশি ভাষা শেখা প্রয়োজন, তারা তা অপেক্ষাকৃত কম সময়ে আয়ত্ত করে নেয় বা নিতে পারে। এক্ষেত্রে ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষা শেখার জন্য ১৬ কোটি লোককে টেনে পণ্ডশ্রমে নিয়োজিত করার প্রয়োজন আছে কি?
তবে বর্তমানে ইংরেজি যেহেতু আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছে এবং যেহেতু দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে একটা সুবিধাবাদী শ্রেণী ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এবং যেহেতু শিক্ষার্থীর একটা অংশ উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার জ্ঞান অপরিহার্য মনে করেন, সেহেতু ইংরেজি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। এতেও যদি কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষে ইংরেজি ভাষার জ্ঞান অর্জন সম্ভব না হয়, তাহলে তার পক্ষে কোনো দিনই তা সম্ভব হবে না।
লক্ষণীয়, একটা এলিট শ্রেণী শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দেখা দিতে শুরু করেছে, যারা ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র শ্রেণীরূপে প্রকাশ করে গৌরববোধ করছে। ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সেখানে নিুবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের অবহেলিত সন্তানদের খোয়াড়ে পরিণত হতে পারে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিলেই যথেষ্ট নয়। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যহীন একটা সুষমনীতি অনুসরণ অত্যাবশ্যক। নইলে সমাজে বৈষম্য ও অবিচার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
প্রফেসর মোহাম্মাদ আসাদুজ্জামান : শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, ২০১৭ সালে জনপ্রশাসনে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত
সূত্র: যুগান্তর