পরীক্ষা : অকারণে হুলস্থূল? - দৈনিকশিক্ষা

পরীক্ষা : অকারণে হুলস্থূল?

আমিরুল আলম খান |

গত মঙ্গলবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় যশোর শিক্ষা বোর্ডে যা ঘটেছে, তা রীতিমতো অবাক কাণ্ড বটে। তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পরীক্ষা ছিল। কিন্তু প্রশ্নপত্রের নৈর্বাচনিক প্রশ্নের ঘ সেটে এক পাতায় পরের দিনের ক্যারিয়ার শিক্ষার প্রশ্ন ছাপা ছিল। কী কী কারণে এমন অদ্ভুত কাণ্ড হতে পারে, তা নিয়ে এখন চলছে নানা গবেষণা। বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাপার সময়ই এমন বিভ্রাট ঘটেছে। আর এ নিয়ে সারাদেশে এখন যশোর বোর্ড আসামির কাঠগড়ায়। তবে খবর নিয়ে যা জেনেছি, তা ফিকশনের চেয়েও অবিশ্বাস্য! দেশবাসীর জন্য তা নিবেদন করতে চাই।

ঘটনার সূচনা ২০১৪ সালে। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড একটি নতুন পাঠ্যবই ছাপে এবং ২০১৫ সালে তা আবশ্যিক হিসেবে পাঠ্য করে। মোট ৫০ নম্বরের এই বিষয়ের নাম ক্যারিয়ার শিক্ষা। এর মধ্যে তত্ত্বীয় অংশে ৩০ এবং ব্যবহারিক অংশে ২০ নম্বর। আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ২০১৭ সালে ক্যারিয়ার শিক্ষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো স্কুলেই কোনো বিষয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থাও নেয়নি সরকার। মাত্র একবার, ২০১৭ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ে ৫০ নম্বরের ভিত্তিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এক সভায় ১০০ নম্বরের শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা এবং ৫০ নম্বরের ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয় দুটি চালু রাখলেও কেন্দ্রীয় পরীক্ষা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, এ দুটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নবম ও দশম শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে এবং ধারাবাহিক মূল্যায়নের সে নম্বর স্কুল থেকে সরাসরি বোর্ডে পাঠাতে হবে। একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টে সে নম্বর উল্লেখ করা হবে বটে; কিন্তু গ্রেড নির্ধারণে এই নম্বরের কোনো ভূমিকা থাকবে না!

সেই ২০১৭ সালের পরীক্ষায় যেসব পরীক্ষার্থী ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ে ফেল করেছিল, তাদেরই অবশিষ্টাংশের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি)। দেশের সব বোর্ডের পক্ষে ঢাকা বোর্ড ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে। বিজি প্রেসে সে প্রশ্ন ছেপে সেখান থেকে অন্যান্য বোর্ডে সরবরাহ করা হয়। সারাদেশে হয়তো ক্যারিয়ার শিক্ষায় হাজার চারেক পরীক্ষার্থী ছিল। কিন্তু গতকালের যশোর বোর্ডের আইসিটি প্রশ্নে ভুলক্রমে ক্যারিয়ার শিক্ষা প্রশ্নের একটি অংশ ছাপা হয়ে পরীক্ষার্থীদের হাতে চলে যাওয়ায় গতকাল অনুষ্ঠিত আইসিটি পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এখন আইসিটি পরীক্ষা হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি আর ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ে পরীক্ষা হবে আগামী ২ মার্চ।

সঠিকভাবে আমার জানা নেই, ঠিক কতজন পরীক্ষার্থী ২০১৭ সাল থেকে শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা এবং ক্যারিয়ার শিক্ষার এই ঘানি টেনে চলেছে। এখন আমাদের প্রশ্ন, শিক্ষা বোর্ডগুলো ২০১৮ সাল থেকে যে বিষয় দুটির আর কেন্দ্রীয় পরীক্ষা গ্রহণ করছে না, সে দুটি বিষয়ে পরীক্ষার্থীদের কি পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দেওয়া যেত না? কেননা, এ বিষয় দুটি আর পরীক্ষার্থীর গ্রেড নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখছে না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক বোর্ড নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের সবাই মনে করেন, এখন আর শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা এবং ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয় দুটি পরীক্ষা গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা নিয়ে হযবরল কাণ্ড চলছে অনেক কালজুড়ে। বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে কখন কোন পণ্ডিত কোন পরামর্শ নিয়ে হাজির হন, আর দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থী তার অসহায় শিকারে পরিণত হন, তা একমাত্র মাবুদ জানেন। আর কোনদিন যে এই অব্যবস্থাপনা থেকে জাতি মুক্তি পাবে, তাও বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটা বিষয় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য কোনো কোনো গোষ্ঠী খুবই তৎপর। সেই চক্রটিই বারবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে চেপে অভাবনীয় কাণ্ড করে চলেছে।

আমরা শুধু উপাধিধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছি আর বিসর্জন দিয়েছি সত্যিকারের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সাধনা। শিক্ষার্থীদের কাঁধে আমরা দানবের মতো বইয়ের বোঝা বাড়িয়ে চলেছি এবং চাপিয়ে দিয়েছি পরীক্ষার জগদ্দল পাথর। আমরা চার কোটি গিনিপিগ পেয়ে তাদের ওপর দুনিয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়ে আমাদের তরুণ ও যুব শক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলছি। শিশুদের কাঁধে বইয়ের পাহাড় আর শিশুর সব আনন্দ আজ নির্বাসিত। আমরা শিক্ষাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছি আর করেছি কিছু বিদ্যাবণিকের লুণ্ঠনের অবাধ ক্ষেত্র। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এখন সার্টিফিকেট বিকিকিনির হাট। আনন্দহীন সার্টিফিকেট কেনার জন্য সন্তানরা আজ কোচিং সেন্টার আর নোট-গাইড বণিকদের কাছে জিম্মি।

আমরা শুধু গর্ব করে বলছি, দেশে চার কোটি তরুণ শিক্ষার্থী আছে, যা অনেক দেশের মোট জনসংখ্যারও বহুগুণ বেশি। কিন্তু জোর করে বলতে পারছি না, শিক্ষারথ সঠিক পথে ধাবমান। তাই শিক্ষা আজও জীবিকার সুযোগ নিশ্চিত করে না, বরং প্রতি বছর তৈরি করে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার। 

আমি কিছু মনোচিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি। শুনেছি, তাদের সতর্কবাণী। পত্রিকা ও টিভিতে অনেক রিপোর্ট পড়েছি। তারা বলছেন, শিশুর ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। এখনই সতর্ক না হলে সমগ্র জাতি সামষ্টিক মনোবৈকল্যের শিকার হতে পারে। ইতিমধ্যেই আমরা সে সামষ্টিক মনোবৈকল্যের শিকার হয়ে গেছি। তা না হলে বাবা-মা কেন শিশুদের ওপর অহর্নিশ অত্যাচার চালাবে! শুধু জিপিএ ৫ না পাওয়ার কারণে দেশের কত শিশু আপন জনক-জননীর হাতে নির্যাতনের শিকার, সে খোঁজ কি রাখি? আমাকে ভোলা থেকে একজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুদীপ্ত মেইল করে জানতে চেয়েছে, 'কেন ছাত্রছাত্রীরা এ-প্লাস পাওয়ার জন্য এত দৌড়ায়? কেন স্কুল থেকে বাসায় ফিরলে মা-বাবা আগে জিজ্ঞেস করেন- 'এ-প্লাস পেয়েছিস তো?' কেন তারা জানতে চান না, স্কুলে কী শিখলাম বা জানলাম? কেন ছাত্রছাত্রীরা জানতে বা বুঝতে চায় না? আচ্ছা, এ-প্লাস পাওয়া কি খুব জরুরি? এ-প্লাস না পেলে কি আমাদের জীবন ব্যর্থ, স্যার?' এই কিশোরের মনের আর্তি কি আমরা বুঝি? সুদীপ্ত যে সারাদেশের কিশোর-তরুণের প্রতিনিধি, তা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারি? কী জবাব দেব আমি, আমরা? সুদীপ্ত সমগ্র জাতির বিবেকের কাছে যে প্রশ্ন তুলেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার কী জবাব দেবে? 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমে গেছে বহু আবর্জনা। সে আবর্জনার স্তূপ সরাতে চাই সাহসী নেতৃত্ব। জাতি সে অপেক্ষায় থাকল। 

 

লেখক: যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0071749687194824