শিক্ষার্থীরা শিখছে, তবে খণ্ডিতভাবে। শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, বছরের নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবইয়ের পুরোটা পড়ানোর কথা থাকলেও শিক্ষকরা বিবেচনায় নিচ্ছেন পরীক্ষাকে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থী-অভিভাবকের চাপে নির্বাচিত কিছু অধ্যায় পড়িয়েই শেষ করছেন সিলেবাস। পরীক্ষাকেন্দ্রিক এ পাঠদানে দুর্বলই থেকে যাচ্ছে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার ভিত। সাম্প্রতিক নানা গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। মঙ্গলবার (২১ মে) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশের একদল গবেষক দেশের মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষা ও এর প্রভাব নিয়ে গত বছর একটি গবেষণা চালান। এতে নেতৃত্ব দেন নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টারবারির স্কুল অব টিচার এডুকেশনের শিক্ষক জ্যানিনকা গ্রিনউড ও মো. আল আমিন নামের এক গবেষক।
গবেষণার অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরিপ চালানো হয়। জরিপ চালাতে গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন গবেষকরা। জরিপে পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে ‘দি এক্সামিনেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট: অন কারিকুলাম, স্টুডেন্টস, টিচার্স অ্যান্ড সোসাইটি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন তারা, যা সম্প্রতি জার্মানিভিত্তিক প্রকাশনা স্প্রিঞ্জারে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের ৬৭ শতাংশ জানিয়েছেন, স্কুলের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকরা তাদের সবসময় যে পদ্ধতিতে পড়ালে শিক্ষার্থীর ভালো নম্বর নিশ্চিত হবে, সেভাবেই পড়ানোর নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ৭১ শতাংশ শিক্ষক জানান, পরীক্ষায় সন্তানের ভালো নম্বর নিশ্চিত করতে চাপ প্রয়োগ করেন অভিভাবকরা। অন্যদিকে ৮০ শতাংশ শিক্ষক জানান, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা থাকে যেসব বিষয় পরীক্ষায় কমন আসার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলোই যেন শ্রেণীকক্ষে পড়ানো হয়।
কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের এসব নির্দেশনা ও প্রত্যাশা পাঠদান পদ্ধতিকে প্রভাবিত করছে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তাদের পাঠদান পদ্ধতিতে। ৫৭ শতাংশ শিক্ষক গবেষকদের জানান, তারা ক্লাস লেকচার তৈরি করার সময় পরীক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখেন। এছাড়া ৬৫ শতাংশ শিক্ষকই মনে করেন, পরীক্ষা না থাকলে তাদের পাঠদান পদ্ধতি ভিন্ন হতো।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভালো নম্বর বা গ্রেড পাইয়ে দেয়াকেই পাঠদানের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে নিচ্ছে বিদ্যালয়গুলো। অভিভাবকদের মধ্যেও সন্তানের ভালো ফল অর্জন নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীর কাছে জ্ঞানার্জনের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে বেশি নম্বর প্রাপ্তি। নম্বর ও গ্রেডনির্ভরতার ফলে অর্জিত হচ্ছে না শিক্ষার মূল লক্ষ্য।
পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের বাইরে প্রাইভেট টিউশন ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে প্রিয়া নামের এক শিক্ষার্থীর উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, ওই শিক্ষার্থীর কাছে ইংরেজি বই দেখতে চাইলে সে গবেষক দলের সদস্যদের কাছে নবদূত প্রকাশনীর একটি গাইড বই নিয়ে আসে। সে জানায়, এটি সে বিদ্যালয়ে ও প্রাইভেট পড়তে নিয়ে যায়। এটি দেখেই শিক্ষক তাদের পড়ান। অন্য শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে এ বইই নিয়ে আসে। এ সময় পাঠ্যবইয়ের কথা জানতে চাইলে সে বলে, ‘ওহ, মেইন বুক!’ এরপর আলমারি থেকে সে মূল পাঠ্যবইটি বের করে দেখায়, যা না পড়ার কারণে তখনো অনেক নতুন দেখাচ্ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, শিখন-শেখানোর একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেই পাঠ্যবই লেখা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যালয়ে পাঠদান শেষে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা যা শেখার তা শিখছে না। তাহলে ধরে নিতে হবে, পাঠদান পদ্ধতিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে। পাঠদান পদ্ধতির সমস্যা হচ্ছে, ক্লাসে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠদান দেয়া হচ্ছে না। যে টপিক যেভাবে পড়ানোর কথা, শিক্ষকরা তা অনুসরণ করছেন না। আবার অনেক শিক্ষক নিজেই পাঠ্যবইয়ের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন না। তাই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম অনুসরণে শিক্ষকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের পাঠদানের যোগ্যতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে সম্পূর্ণ পাঠ্য না পড়ানোর ফলে এক ধরনের খণ্ডিত জ্ঞান নিয়েই বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ফলে পাস করে বের হওয়ার পরও মৌলিক অনেক বিষয়ে দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় বিষয়ভিত্তিক শিখন মান যাচাইয়ে ‘লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস’ (লাসি) শীর্ষক এক জরিপ চালানো হয়। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিখন মান কেমন, তা যাচাইয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এ জরিপ চালায়। দেশের ৩২ জেলার ৫২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত ওই জরিপে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। ক্লাস করছে। পাস করে বেরও হচ্ছে। কিন্তু তারা কতটুকু শিখছে? সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে বড় অংকের অর্থ ব্যয়ের কথা বলা হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পও গৃহীত হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে বেরিয়ে আসছে ভিন্ন ফল। তাহলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কী ধরনের ত্রুটি আছে, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। পদ্ধতি ঠিক না করে যত অর্থই ব্যয় করা হোক, সেটি ফলপ্রসূ হবে না।