পরীক্ষার ফল ও খাতা মূল্যায়ন - দৈনিকশিক্ষা

পরীক্ষার ফল ও খাতা মূল্যায়ন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

সিলেটে শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠিত হবার আগে কুমিল্লা বোর্ডে ক’বছর পরীক্ষক হিসেবে কাজ করেছি । তখন  পরীক্ষার খাতা দেখে যে তৃপ্তি পাওয়া যেত , এখন সেটি নেই । তিনটে শব্দের বানান ভুল হলে এক নম্বর কেটে দেবার নিয়ম ছিল । এখন বানানে ফ্রি স্টাইল । প্রধান পরীক্ষকের জন্য তখন পরীক্ষকদের ভয় থাকতো । সঠিকভাবে খাতা না দেখলে ডেকে পাঠাবে । বিল কাটবে । আগামীতে পেপার দেবে না- ইত্যাদি আরো কত কী ! আজকাল এর উল্টো । নম্বর কম দেয়া যাবে না, প্রান্তিক নম্বর এভয়েড করতে হবে – ইত্যাদি নানা কথা । সে সময় যে পাস করার সে-ই পাস করতো , আর যে ফেল করার  সে নিশ্চিত ফেল। পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে বিতর্ক ছিল না । যে ফল যে পেতো , সেটিই তার জন্য উপযুক্ত বলে সকলের বিশ্বেষ হতো । পাসের হার ৩০ শতাংশ থেকে ৫০শতাংশ এর মধ্যে ছিল । আজকাল সঠিক ফল ক’জনে পায় ?  ইদানিং বছর কয়েক ধরে অনেক সময় যে পাস করার কথা নয়, সে পাস করে বসে আর যে পাস করার কথা সে ফেল করে । এমন ও পরীক্ষার্থী দেখেছি যারা সারা বছর পড়াশুনা না করে আড্ডা-ইয়ার্কি মারে । অথচ পরীক্ষায় এ + পেয়ে যায় । আবার ভাল ছাত্র যে ফেল করার কথা নয় – সে ফেল করে বসে । এভাবে তবু এ ক’বছরে পাসের হার প্রায় একশ’র কাছাকাছি চলে যায় ।

আগে পরীক্ষক হবার জন্য কিছু শর্ত ছিল । সে সব শর্ত পূরণ হলে কেবল পরীক্ষক হওয়া যেত । মনে পড়ে , শিক্ষকতার বেশ ক’বছর পর তিন তিন বার আবেদন করে পরে পরীক্ষক মনোনীত হবার চিঠি পাই । আজকাল অনেকে শিক্ষকতার এক-দু’বছর যেতে না যেতে পরীক্ষক এমনকি প্রধান পরীক্ষক পর্যন্ত হয়ে যায় । এখন পরীক্ষক হতে কোন বিশেষ শর্ত লাগে কীনা জানিনে । কেবল শিক্ষক হলেই হলো । এমন অনেক পরীক্ষককে চিনি, যারা সবে মাত্র দু’এক বছর হয় শিক্ষকতা শুরু করেছেন । অথচ তারা এখন পরীক্ষক । খাতা দেখার মাত্র ক’বছরের অভিজ্ঞতায় অনেকে প্রধান পরীক্ষক হয়ে যান । এমন অনেককে ও জানি, যারা যে বিষয়টি পড়ান না কিংবা নিজে ও পড়েননি এখন তিনি সে বিষয়ের পরীক্ষক কিংবা প্রধান পরীক্ষক । আর হবেই বা না কেন ? চারু ও কারু কলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা, জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষার মতো বিষয়গুলোর তো কোন শিক্ষকই নেই । আইসিটি এবং উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও বিপনন সহ কয়েকটি আবশ্যিক বিষয়ের  শিক্ষক একেবারে হাতে গোনা ক’জন । এ সব বিষয়ের খাতা দেখবে কে ? আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, বিষয় সংখ্যা ও তেমন । আমরা এসএসসি পর্যায়ে দশটি বিষয় পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিয়েছি । এখন সে জায়গায় চৌদ্দটি । আশির দশকের গোড়ায় যেখানে আমাদের পুরো থানা ( উপজেলায় ) একটি মাত্র কেন্দ্রে  সত্তর-আশি জন পরীক্ষার্থী ছিল,  সে জায়গায় আজ চারটি কেন্দ্রে দু’ হাজারের ও বেশী । এ ভাবে সারা দেশে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। পরীক্ষা ও বেড়েছে । পিইসি কিংবা জেএসসি আমরা পাইনি । এখন পরীক্ষায় পরীক্ষায় সারাটি বছর কাভার হয়ে যায় ।
বর্তমান সময়ে চার বিষয়ে ফেল করে ও পরের বার ঐ চার বিষয়ে পরীক্ষা দেয়া যায় । আমাদের সময় এক বিষয়ে ফেল করলে পরের বছর সব বিষয়  পরীক্ষা দিতে হতো । মাঝে কেবল কয়েক বছর এক বিষয়ে ফেল করলে পরের বছর রেফার্ড দেয়ার সুযোগ ছিল । তারপর এ- ও ওঠে যায় । যারা রেফার্ড দিয়ে পাস করতো, তাদের সার্টিফিকেট ও মার্কস সীটে ‘বিশেষ পাস’ কিংবা ‘রেফার্ড’ লেখা থাকতো । এখন চার বিষয়ে রেফার্ড দিয়ে পাঁচ বছরে একটা পরীক্ষা পাস করলেও সার্টিফিকেটে এ জাতীয় কোন কিছু লেখা থাকে না । কেবল সেশনটা দেখে কেউ কিছু বুঝার চেষ্ঠা করলে হয়ত বুঝতে পারে ।
আমাদের শিক্ষা এখন পরীক্ষা পাসের জন্য । পাসের হার কার কত-সেটুকু জানবার জন্য । এ ক’টা বছর এক বোর্ডের সাথে আরেক বোর্ডের পাসের হার নিয়ে প্রতিযোগিতা চলেছে । এক স্কুলের সাথে আরেক স্কুলের । এক কলেজ আরেক কলেজের সাথে পাসের হার বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা করেছে । এক গার্জিয়ান আরেক গার্জিয়ানের সাথে সন্তানের পরীক্ষায় জিপিএ বাড়াবার প্রতিযোগিতা করেছে । এর ফলে প্রশ্নফাঁস বেড়েছে । নোট-গাইড ও কোচিংয়ের প্রসার বেড়েছে ।  বেড়েছে জিপিএ-৫ । বেড়েছে পাসের হার । একেবারে একশ’র কাছাকাছি চলে গেছে পাসের হার। কিন্তু, তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি । প্রকৃত মেধা যাচাই করা যায়নি । জ্ঞানার্জনের প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়নি । এ এক অশুভ প্রতিযোগিতা । এর ফল শুভ হয়নি । হতে পারেনা ।
পরীক্ষায় যা-তা লিখে পাস করা গেলে এত টাকা ও সময় ব্যয় করে পরীক্ষা অায়োজনের মানে কী ? যেনতেন ভাবে খাতা মুল্যায়নের কোন মানে হয় না । আজকাল পরীক্ষা যেন এমন হয়েছে যে, পরীক্ষার জন্য পরীক্ষার্থীদের কোন টেনশন থাকে না । টেনশন করতে ও হয় না । খাতা মুল্যায়নে অতি উদারতা প্রদর্শনের কারণে আজকাল ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা নিয়ে কোন ভাবনা নেই ।
‘পরীক্ষার পূর্ব রাত্রি’ নামে এসএসসি বা এইচএসসি পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ছিল । সে প্রবন্ধটি পড়ে বুঝা যেত- তখন পরীক্ষার্থীরা সারা বছর তো বটে পরীক্ষার আগের রাতে ও কত সিরিয়াস ছিল ।  আর এখন ?  সারা বছর তো লেখাপড়া নেই-ই, পরীক্ষার আগের রাতে ও তাদের লেখাপড়ার এতটুকু গরজ দেখা যায় না । প্রশ্নফাঁসের  সুযোগ নিতে পারলে পড়াশুনার কী প্রয়োজন ? আবার যা তা লিখে পাস করা গেলে রাত জেগে জেগে পড়ার তো দরকার পড়ে না । এখন তাই ‘পরীক্ষার পূর্বরাত্রি’ প্রবন্ধটি ও নেই আর সে সময়ের পড়াশুনা ও নেই ।
তদুপরি সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর বিভাজনটা এমন  – পরীক্ষক যদি এর গভীরে গিয়ে উত্তরপত্র মুল্যায়ন না করেন তবে শিক্ষার্থীর অবলীলায় পাস নম্বর কেন, অনেক বেশী পাওয়া খুব সহজ হয়ে ওঠে । এ ক’বছরে হয়েছে ও তা-ই ।  প্রশ্নপত্রে যেটুকু সৃজনশীলতার চর্চা থাকে, উত্তরপত্রে সেটুকু খোঁজে পাওয়া যায় না ।
সে আগে থেকে এখনো পরীক্ষককদের খাতা দেখার সম্মানী যেমন অল্প তেমনি তারা তা এক বছর পরে এটি হাতে পেয়ে থাকেন । এ কেমন কথা ? সাথে সাথে না পারলে দু’মাসের মধ্যে দেয়া যাবে না কেন ? শিক্ষার্থীরা তো পরীক্ষার তিন মাস আগেই ফি দিয়ে দেয় । পরীক্ষকদের তা দিতে অহেতুক বিলম্ব কেন ? একজন পরীক্ষক তিনশ’ থেকে চারশ’ খাতা দেখেন । একজন প্রধান পরীক্ষক দেখেন এক হাজার থেকে বারশ’ খাতা । সময় দেয়া হয় দশ থেকে বারদিন। এত অল্প সময়ে একজন শিক্ষক এতগুলো খাতা দেখেন কী করে ? তদুপরি, খাতা মুল্যায়নের চেয়ে খাতার আনুষাঙ্গিক অন্যান্য কাজ ; যেমন- খাতার ক্রমিক নম্বর, বান্ডিল নম্বর, পরীক্ষক কোড,প্রাপ্ত নম্বর ইত্যাদি লিখে প্রতিটি বৃত্ত ভরাট করতেই অনেক সময় কেটে যায় । খাতা দেখা শুরু করার আগেই এ সবের অনেকটা কাজ করে শিক্ষক ক্লান্ত হয়ে পড়েন । কেবল প্রাপ্ত নম্বরের কাজটা আগে করা যায় না । খাতা মুল্যায়ন শেষে সে কাজটি করা লাগে ।
শিক্ষার্থীদের এখন শিক্ষকদের ভয় নেই। শিক্ষক উল্টো নিজে শাস্তি পাবার ভয়ে তাদের কোন প্রকার শাস্তি দেন না । শিক্ষকের ভয়ে আজকাল ছাত্রদের পড়াশুনার দরকার পড়ে না । পরীক্ষার হলে ও পর্যবেক্ষকদের ভয় করা লাগে না । শিক্ষকের চোখ রাঙানোর ভয় শিক্ষার্থীদের নেই। উল্টো শিক্ষকরা ভয়ে অনেকে পরীক্ষার হলে ডিউটি করতে সাহস পান না ।
তাহলে শিক্ষার্থী পড়াশুনা করবে কেন ? ফেল করার ভয় নেই। শিক্ষককে ও ভয় নেই । কিসের ভয়ে পড়বে তারা ? কোন গরজে লেখাপড়া করবে  ?
অবশ্য বিষয়টি এখন আস্তে আস্তে  অনেকের মাথায় ধরেছে । এভাবে চলতে দেয়া যায় না । জাতির জন্য এটি কোনমতে শুভনীয় নয় । প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে । এ প্রচেষ্টা কিছুটা হলে ও শুরু হয়ে গেছে । গত দু’টো এসএসসি পরীক্ষার ফলে তা একটু হলে ও প্রতীয়মান হয়েছে ।
বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু)’র একটি কর্মশালায় গত ডিসেম্বরে ঢাকায়
খাতা মুল্যায়নে নির্ভরযোগ্য নম্বর প্রদানের বিষয়ে যা আলোচিত হয়েছে, তার অনেকটা প্রতিফলন সম্প্রতি ঘোষিত এসএসসি পরীক্ষার ফলে লক্ষ্য করা গেছে । লেখাপড়া না করে পরীক্ষায় পাস করার দিন ফুরিয়ে এসেছে । এ বার্তাটি শিক্ষক , শিক্ষার্থী , অভিভাবক-সকলকে এখনি জানিয়ে দিতে হবে ।
অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী: চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট  দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039889812469482