ড. মাহবুবা ইসলাম। তিনি বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক (উদ্ভিদবিদ্যা)। মূল পদ সরকারি কলেজ হলেও মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর) মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইং-এর উপপরিচালক পদে ২০০৮ সাল থেকে কর্মরত। এর আগে ২০০২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি উপবৃত্তি প্রকল্পে সহকারী পরিচালক পদে ছিলেন। ১৪তম বিসিএসের মাধ্যমে চাকরি শুরু করে মাত্র কিছু দিন কলেজে পাঠদান করেন।
১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে তিন বছরের ছুটিতে যান। ছুটি শেষে মাউশিতে খুঁটি গেড়ে বসেন। ২০ বছর শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করেও অধ্যাপক পদে পদোন্নতির তালিকায় (গ্রেডেশন লিস্ট) তার নাম দ্বিতীয় স্থানে। একই বিষয়ে পদোন্নতির তালিকায় পঞ্চমে রয়েছে ২০০৯ সাল থেকে মাউশির বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষক নাসির উদ্দিন বুলবুল।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের সচিব ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী ২০০৯ সালে বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক পদে প্রেষণে যোগদান করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত সচিব থেকে সচিব হন। অর্থনীতির এই শিক্ষক টানা নয় বছর শিক্ষকতার বাইরে থাকলেও অধ্যাপক পদোন্নতির তালিকায় তার নাম ৯ নম্বরে। একইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের পরিদর্শক বাংলার শিক্ষক মো. আবুল বাশার ১১ নম্বরে, দর্শনের শিক্ষক নায়েমের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) কালা চাঁদ শীল ১১ নম্বরে, সম্প্রতি এনসিটিবির সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া অর্থনীতির শিক্ষক ইমরুল হাসান ৫ নম্বরে, ডিআইএ থেকে সম্প্রতি বদলি হওয়া ব্যবস্থাপনার শিক্ষক রাশেদুজ্জামানের নাম ১১ নম্বরে। তাদের মতো আরও অনেকের নাম রয়েছে পদোন্নতি তালিকার শীর্ষে। যারা বছরের পর বছর শিক্ষকতা থেকে দূরে। এছাড়া বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষকদের নামও রয়েছে তালিকায়।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুলস (বিএসআর) ১৯৮১ এর ৫, ৬ ও ৭ বিধি অনুযায়ী- বিসিএসের মাধ্যমে সব ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস ও শিক্ষানবিসকাল শেষে চাকরি স্থায়ী হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস বাধ্যতামূলক।
শিক্ষা ক্যাডারের যারা এসব যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ তাদের চাকরির মেয়াদ ১৫ বছর পূর্ণ হলে পরীক্ষা প্রমার্জন (বিশেষ ক্ষমা) সাপেক্ষে পদোন্নতি পাবেন। প্রমার্জনপ্রাপ্তরা প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলে পাঁচ বছর ওই পদে কর্মরত থাকার পরে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য হবেন। কিন্তু কোনোভাবেই অধ্যাপক হতে পারবেন না। যারা বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস করেছেন তারাই শুধু সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছর ফিডার সার্ভিস পূর্তিতে সহযোগী অধ্যাপক এবং দুই বছর ফিডার সার্ভিস পূর্তিতে অধ্যাপক হতে পারবেন। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে বিধি লঙ্ঘন করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষা ক্যাডারে চরম অন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। প্রসঙ্গত, ফিডার সার্ভিস বলতে শিক্ষা ক্যাডারের মূল পদ সরকারি কলেজে কর্মরত থাকা।
মাউশির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপকদের অবসরে যাওয়ার হিসাব করে ১৯টি বিষয়ের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাতে ১০৯১ জনের নাম রয়েছে। সারা দেশের সরকারি কলেজে বর্তমানে ৯৮টি অধ্যাপক পদ শূন্য রয়েছে। আর আগামী ডিসেম্বরে ৮০ জন অবসরে যাবেন। এ হিসাব অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে।
তবে গত বছরের ১০ নভেম্বর ২৭৪ জনকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হলেও তাদের পদে বসাতে পারেনি মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে ৫৮ জন গতকাল পর্যন্ত ‘ইনসিটু’ (পদোন্নতির পরও সুবিধামতো জায়গায় থাকতে নিচের পদে চাকরির ব্যবস্থা) আছেন। ২০১৪ সালে পদোন্নতির সময় ইনসিটু বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি আর কার্যকর হয়নি।
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা ক্যাডারটি পার্শ্ব (লেটারাল এন্ট্রি) প্রবেশের। অর্থাৎ বিসিএস পরীক্ষায় পাস না করেও আত্তীকৃত শিক্ষক, পদর্শক থেকে পদোন্নতিসহ বিভিন্নভাবে এ ক্যাডারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। বিধি অনুযায়ী শিক্ষা ক্যাডারের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে যোগদানের তারিখ থেকে। পদোন্নতির খসড়া তালিকা করার ক্ষেত্রে এ বিধানও মানা হয়নি। নিয়ম মেনে পদোন্নতি না দেওয়ায় ৭ম থেকে ১৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। এবারের পদোন্নতি তালিকাতেও বিভাগীয় পরীক্ষায় পাসসহ নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে আসাদের নাম রয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচের দিকে। এতে করে তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন।
এ ব্যাপারে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘এখনও কিছুই হয়নি। শুধু এসিআর (বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন) যাচাই-বাছাই হয়েছে। কোনো চূড়ান্ত তালিকা করা হয়নি। কিছু ব্যক্তি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। পদোন্নতির যোগ্যতায় কারও ঘাটতি থাকলে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হবে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনোরকম অনিয়ম হবে না।’
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে গত সপ্তাহে ‘বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি)’ সভা হয়েছে। তালিকা থেকে বিষয় ভিত্তিক ২০ শতাংশ সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিষয়ভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী-পদার্থবিদ্যা বিষয়ে ৪৯ জন, পরিসংখ্যানের দুই জন, প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে ৬৩ জন, বাংলায় ৮০ জন, ব্যবস্থাপনায় ৬৯ জন, ভূগোলে সাত জন, মৃত্তিকা বিজ্ঞানে তিন জন, মনোবিজ্ঞানে চারজন, রসায়নে ৪২ জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৭৮ জন, সমাজবিজ্ঞানে ১৩ জন, সমাজকল্যাণে ২৯ জন, সংস্কৃতিতে একজন, হিসাব বিজ্ঞানে ৬৩ জন, অর্থনীতি ৮১ জন, আরবি বিষয়ে আটজন, ইসলামী শিক্ষায় ২৭ জন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ৭২ জন, ইংরেজিতে ৭৯ জন, ইতিহাসে ৭৯ জন, উদ্ভিদবিদ্যায় ৭৮ জন, গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ছয়জন, গণিতে ৫৯ জন, দর্শনে ৮৫ জন। এছাড়া টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ইতিহাসে একজন, ভূগোলে একজন, বিজ্ঞানে একজন, শিক্ষায় নয়জন, গাইডেন্স অ্যান্ড কাউন্সিলিংয়ে একজনের নাম রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, শিক্ষামন্ত্রী বর্তমানে তার নির্বাচনী এলাকায় রয়েছেন। তিনি ফিরলেই ডিপিসির সভা করে পদোন্নতির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
২০০৬ সাল থেকে ২০১৭ সালের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতা তালিকা ও ফিট লিস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ও ২৩ অক্টোবর দুই দফায় ৫৮৭ জন পদোন্নতি প্রাপ্ত অধ্যাপকের মধ্যে ১৫৪ জন এবং ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবরে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৩৬৭ জন অধ্যাপকের মধ্যে দুই শতাধিক বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করা। ২০১৪ সালে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ১৪৮ জন অধ্যাপক অযোগ্য ছিলেন।
পদোন্নতি বঞ্চিত শিক্ষকদের অভিযোগ, চাকরি বিধি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে গত সাত বছরে প্রায় এক হাজার অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করা। কারও আবার চাকরিই স্থায়ী হয়নি। তবুও অধ্যাপক হয়েছেন। তারাই এখন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর, শিক্ষাবোর্ডসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং ঐতিহ্যবাহী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ছেন। অযোগ্যদের পদোন্নতি দেওয়ায় প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক বঞ্চিত হয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাউশির একটি সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের পদোন্নতিতে কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
গত বছর অধ্যাপক হওয়া (বর্তমানে উপসচিব) ফারহানা হক ছিলেন সব চেয়ে আলোচিত। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করে তিনি টানা ১৮ বছর শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। গত বছর অধ্যাপক হয়েই ১০ শতাংশ কোটায় উপসচিব হয়েছেন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক ছিলেন দিদারুল আলম। তিনি ৩৩ বছর চাকরি জীবনের মাত্র ছয় মাস শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেছেন। সেসিপের উপপরিচালক ড. শামসুন নাহার ২০০১ সাল থেকে মাউশিতে বিভিন্ন পদে আছেন। তাদের মতো আরও অর্ধ শতাধিক শিক্ষক বছরের পর বছর শিক্ষক ছেড়ে প্রশাসনিক পদে বসে অবৈধভাবে পদোন্নতি পেয়েছেন।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আইকে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, ‘অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেস টু কেস যাচাই-বাছাই করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও উচিত একইভাবে পদোন্নতি দেওয়া। এতে যোগ্যরাই পদোন্নতি পাবেন। বঞ্চিতদেরও ক্ষোভ থাকবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারি বিধান অনুযায়ী কারও তিন বছরের বেশি একই পদে থাকা উচিত নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটাই বিশ্বাস করি।’
সৌজন্যে: আজকালের খবর