বিশেষজ্ঞ প্রস্তাব ও বিভিন্ন মহলের দাবি থাকলেও পাঠ্যবই থেকে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে না। বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন ছাড়াই আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, এবার পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা যে ১২টি বই নিয়ে কাজ করেছেন, সেগুলোতে শুধু পরিমার্জন করা হয়েছে। এর ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিগুলো থাকবে না।
চলতি বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে বিশেষ করে বাংলা ও আনন্দপাঠে বিষয়বস্তু পরিবর্তনে হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রতিফলন ঘটে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠন ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলেছিল, যার সব কটি মেনে নেওয়া হয়। এমনকি সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই কয়েক লাখ কপি ছাপার পর সেগুলো গুদামে রেখে দুটি লেখা বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপানোর ঘটনাও ঘটে।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর চলতি বছরের শুরুতে প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো পুনঃস্থাপন করে আগামী বছরের পাঠ্যবই ছাপার দাবি তোলেন। পাশাপাশি মাধ্যমিকের ১২টি বই নির্ভুল ও সহজ করার জন্য যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, তার একটির প্রধান নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বই থেকে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো পুনঃস্থাপন করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন।
ওই দুটি শ্রেণির বাংলা বইয়ে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী পাঁচটি পদ্য বাদ দেওয়া হয়। সেগুলো হলো জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, লালন শাহর ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’। বাদ দেওয়াগদ্যটি হলো ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’। এসবের পরিবর্তে শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘বন্দনা’, আলাওলের ‘হামদ’, আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’, গোলাম মোস্তফার ‘জীবন বিনিময়’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘উমর ফারুক’ কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বাংলা ও আনন্দপাঠে এভাবে বিভিন্ন গল্প-কবিতা বাদ দিয়ে নতুন গল্প-কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ বিষয়ে কয়েক দিন ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবিতে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ে বিষয়বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। কেবল প্রাথমিকের পাঠ্যবই থেকে গাছে ওঠানো ছাগলের ছবি নামানো, ‘ও-তে ওড়নার’ বদলে ‘ওজন’ শব্দ ও ছবি অন্তর্ভুক্ত করাসহ কিছু ভুল ও বিতর্কিত বিষয় পরিমার্জন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পাঠ্যবই নিয়ে সব সময়ই কিছুটা ভিন্নমত থাকে। সবকিছু বিবেচনা করেই সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। এবারও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ১২টি বই পরিমার্জন করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞ প্রস্তাব ও বিভিন্ন মহলের দাবি থাকলেও পাঠ্যবই থেকে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো পুনঃস্থাপন করা প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলেননি।
এনসিটিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল রোববার বলেন, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বাদ দেওয়া আগের গল্প-কবিতাগুলো পুনঃস্থাপন করার প্রস্তাব করলেও যেহেতু ওই কমিটির কাজ ছিল শুধু পরিমার্জন করা, ফলে তাঁর প্রস্তাব আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, তাঁরা মনে করেন পাঠ্যবইয়ে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হওয়া উচিত। কারণ, পাঠ্যবই পড়ে শিশুরা গড়ে ওঠে। সেখানে যদি হেফাজতীকরণ হয়, তাহলে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নষ্ট করে, যা রাষ্ট্রচেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ জন্যই পাঠ্যবইগুলো আবারও পর্যালোচনা করা উচিত।
উল্লেখ্য, এবার প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ২০৭টি বই ছাপা হচ্ছে।