ব্যক্তির জীবনাচরণে শৈশবের শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তকের প্রভাব অপরিসীম। তাই পাঠ্যপুস্তকের বর্ণমালা পরিচয়ে জীবনঘনিষ্ঠ অর্থবহ শব্দ অন্তর্ভুক্তির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এ সময়ের করোনা মহামারী এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শিশুদের মধ্যে হাত ধোয়ার অভ্যাস জোরদার করতে হবে। এজন্য পাঠ্যক্রমে ‘হ-তে হাত ধোয়া’, ‘এইচ ফর হ্যান্ডওয়াশিং’ অন্তর্ভুক্ত হলে তা কাজে আসবে। ইউনিলিভার বাংলাদেশ আয়োজিত ‘হ-হাত ধোয়া, সুরক্ষিত হাতে সুরক্ষিত দেশ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বুধবার আলোচকরা এ মত দেন।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় এ ওয়েবিনারে অংশ নেন ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেদার লেলে, ইউনিসেফ বাংলাদেশের ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন (ওয়াস) বিভাগের প্রধান ডারা জনস্টন, সেভ দ্য চিলড্রেনের ডিরেক্টর অব প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি রিফাত বিন সাত্তার, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ওরলা মারফি, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ এবং ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. দীপু মনি বলেন, ‘ছোটবেলায় শিশুরা যা শেখে তা জীবনব্যাপী তাদের কাজে দেয়। তাই শরীরের রোগব্যাধি মোকাবেলায় শৈশব থেকেই হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা খুবই জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘হাত ধোয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়টি আমরা সবাই জানি। কিন্তু এগুলো চর্চায় এখন আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশের অর্ধেক মানুষ এখনো সঠিকভাবে হাত ধোয়ার বিষয়টি সর্ম্পকে সচেতন নন।’
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শুধু ডায়রিয়া বা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে নয়, বরং পুষ্টিহীনতা এবং কৃমির মতো শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে রক্ষা পেতেও হাত ধোয়ার বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, কোভিডের কারণে মাস্ক পরাসহ নাকে-মুখে অযথা হাত না দেয়া এবং সঠিকভাবে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উঠে এসেছে। এগুলোর মধ্যে শুধু হাত ধোয়ার মাধ্যমেই আমাদের শরীরে রোগব্যাধির হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বর্তমানে স্কুল বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে এবং আমরা অনলাইনে শিক্ষার্থীদের বলছি পরিচ্ছন্নতা এবং হাত ধোয়ার অভ্যাসটি নিয়মিতভাবে মেনে চলার জন্য। পুনরায় খোলার পূর্ব শর্তই হবে সঠিকভাবে হাত ধোয়া এবং সাবানসহ পানির উৎস নিশ্চিত করা। দীপু মনি বলেন, ইতোমধ্যেই আমাদের পাঠ্যক্রমে হাত ধোয়াসহ সার্বিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে সেটির চর্চা যেন আরও বাড়ানো যায়, সেই লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষক এবং অভিভাবকদেরও আমাদের সচেতন করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব হয় না। সে কারণে প্রয়োজন সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। ইউনিলিভার এরই মধ্যে কার্যকরভাবে মানুষের কাছে হাত ধোওয়ার বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে, তাই এ ধরনের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়েও তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান কেদার লেলে বলেন, ইউনিলিভার বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের জন্য যেটা ভালো, সেটি ইউনিলিভারের জন্যও ভালো। এ বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে হাত ধোয়া সংক্রান্ত শিক্ষা ও সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালিয়ে আসছে লাইফবয়। তিনি বলেন, শৈশবের শিক্ষা মানুষের বাকি জীবনকেও প্রভাবিত করে। তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য পাঠ্যক্রমে ইংরেজিতে ‘এইচ ফর হ্যান্ডওয়াশিং’ এবং বাংলায় ‘হ- তে হাত ধোয়া’ অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের একসঙ্গে কাজ করার তাগিদ দেন তিনি। ৫ টাকায় লিকুইড সোপ দিচ্ছে লাইফবয়, যেটা ১০ বার ব্যবহার করা যাচ্ছে জানিয়ে কেদার লেলে বলেন, জনগণের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি। ইউনিসেফ বাংলাদেশের ডারা জনস্টন বলেন, করোনা ভাইরাস যে খুব শিগগিরই বিদায় নিচ্ছে না সেটিও স্পষ্ট। এক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোতেও আমাদের হাত ধোয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরও জানান, ২০১৯ সালের জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৭৫ শতাংশ বাড়িতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সাবান ব্যবহার এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি সন্তোষজনক নয়। তবে এ সময়ে ১৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। তিনি বলেন, স্কুলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে দিনে অন্তত একবার দলবদ্ধভাবে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্কুলের টয়লেটগুলো পরিষ্কার রাখা এবং সেখানে পর্যাপ্ত পানি ও সাবানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের রিফাত বিন সাত্তার বলেন, শিশুরা যেন জীবাণুমুক্তভাবে স্কুলে আসতে পারে ও স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরতে পারে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। তিনি বলেন, মানুষ যেন সাবান কিনতে পারে, সেই আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টিও দেখতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছেও যেন হাত ধোয়া এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার তথ্যটি পৌঁছাতে পারে, সেই বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। জীবাণু থেকে সুরক্ষার অভাবে যেন শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ওরলা মারফি বলেন, একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত পাঠের মাধ্যমে যদি শিশুদের সচেতন করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে একটি সুস্থ প্রজন্ম পাব আমরা। পাঠ্যপুস্তকে ও খেলাচ্ছলে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করতে মনোযোগী হয়। এটি কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
ব্র্যাকের আসিফ সালেহ বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৯ শতাংশ মানুষের কাছে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও পানির পর্যাপ্ততা নেই। এ পর্যাপ্ততা সবার কাছে পৌঁছে দিতে ইউনিলিভারের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছে ব্র্যাক। ওয়াটার এইডের হাসিন জাহান বলেন, শুধু ‘হ’-তে হাত ধোয়া’ নয়, জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো যেন পাঠ্যপুস্তকে থাকে। যেমন, ‘প-তে পানি, নিরাপদ পানি নিরাপদ জীবন’। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বিষয়ে সচেতন নয়। কারণ, ‘না জানা’ এবং ‘ব্যবস্থার অপ্রতুলতা’। ওয়েবিনারে জানানো হয়, আজ ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস ২০২০’। এ উপলক্ষে ‘হ-তে হাত ধোয়া’ আন্দোলন শুরু করছে ‘লাইফবয়’। এ আন্দোলনকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন লাইফবয়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। এইচ ফর হ্যান্ডওয়াশিং ডটকম (hforhandwashing.com) সাইটে ঢুকে স্বাক্ষর করে এ আন্দোলনকে সমর্থন করা যাবে।
প্রতিটি স্বাক্ষরের বিপরীতে ৫ শিশুকে হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম শেখানোর অঙ্গীকার করেছে লাইফবয়। এছাড়া খেলার ছলে মজা করে নিজেদের হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে বাচ্চাদের উৎসাহিত করতে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।