দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির মৌসুম চলছে। ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে করতে দু’মাসেরও বেশি সময় লেগে যাবে। বেসরকারি ৯৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আলোচনায় আপাতত নিয়ে আসব না, তার প্রথম কারণ হলো বড় ধরনের অর্থব্যয় থাকায় সেখানে শিক্ষার্থীদের ভিড় ততটা নেই। দ্বিতীয় কারণ হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক।
ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর ও প্রকৌশল- এ চারটি ছাড়া বাদ বাকি ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই রাজধানীর বাইরে সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে। শতকরা হিসাব করলে তা দাঁড়ায় ৯০ শতাংশ। সুতরাং, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আলোচনার ক্যানভাসটা অনেক বড়।
‘অন্য দশটা ব্যাপারে কথার কারসাজিতে আত্মসন্তুষ্টি সন্ধান হয়তো তেমন ক্ষতির কারণ নয় কিন্তু শিক্ষার ব্যাপারে তো তা বলা যায় না। কারণ এর সঙ্গে শুধু যে জাতীয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জড়িত তা নয়, প্রতিটি নাগরিকের মনুষ্যত্ব বিকাশেরও রয়েছে সম্পর্ক। সমাজ, রাষ্ট্র বা জাতি সব কিছুরই প্রাথমিক উপাদান মানুষ। সে মানুষ যদি সুস্থ আর স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ না পায় তাহলে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র দুর্বল আর বিপর্যস্ত হতে বাধ্য।
তাই জাতীয় স্বার্থেই শিক্ষাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে গণ্য করে সেভাবে গড়ে তোলা উচিত। এ দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের।’(শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ: আবুল ফজল;পৃষ্ঠা: ২০৯)। আবুল ফজল তার প্রবন্ধে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা যার মূল উপাদান- শিক্ষার্থী,শিক্ষক ,অবিভাবক ও রাষ্ট্রকে আলোচনায় এনেছেন। কিন্তু এ স্বল্প পরিসরে আমি কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষা আরও নির্দিষ্ট করে বললে ‘ভর্তি সমস্যা’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে দুটি সমস্যাই প্রধান-একটি হলো আসন সংকট, আরেকটি হলো যে পদ্ধতিতে নির্বাচন করা হয় তা। যোগ্য শিক্ষার্থীর তুলনায় আসন সংখ্যার সীমাবদ্ধতা কতখানি তা একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। গেল বছর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিকবিজ্ঞানের বিভাগগুলো নিয়ে গঠিত ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৪০০ আসনের বিপরীতে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৭ হাজার ৬০০। তার অর্থ দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনের কমবেশি দুজন। ভাবা যায়! বাদবাকি ৯৮ জনই অযোগ্য?
এ বিষয়ে অনেকেই কিছু কান-জ্বালা মন্তব্য করে থাকেন- ‘এত উচ্চশিক্ষার দরকারটা কী, শুধু শুধু বেকার বাড়ানো ?’ শিক্ষাগ্রহণ তা যে পর্যায়েই হোক একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আমরা সে অধিকার প্রদানে অক্ষম সে দায় আমাদের, শিক্ষার তো নয়! বেকারত্বের কারণ শিক্ষা নয় বরং যথাযথ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়। আরে ভাই চাকরির দায় তো নিলেনই না, শিক্ষাদানের অক্ষমতার দায়টাও নিতে চাইছেন না?
আসন-সংকটের পরে আসে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি প্রসঙ্গ। প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে পরীক্ষার কাজটি করে থাকে। একটা ন্যূনতম সমঝোতার আলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করে থাকে। সাধারণত এক-দুদিনের ব্যবধানে একজন শিক্ষার্থীকে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুঁটতে হয়। ভাবুন চিত্রটা! সিলেটের একজন শিক্ষার্থীকে যেতে হয় খুলনায়। আর তেঁতুলিয়ার একজন শিক্ষার্থীকে দৌড়াতে হয় চট্টগ্রাম পর্যন্ত। তাও আবার নিশ্চয়তার পরিমান যেখানে ২ শতাংশ। ছেলেদের অনেকে একাই ঘুরে বেড়ায় কিন্তু প্রায় সব মেয়েদের বেলাতেই সাথে বাবা-মা-অবিভাবক থাকেন। কোথায় থাকবেন, কোথায় খাবেন তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকে বিকালে একটি পরীক্ষা দিয়ে রাতেই ছুটছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। আর্থিক দণ্ডের পরিমাণকে আমি কোনোভাবেই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছি না, তবে শিক্ষার্থী-অবিভাবকদের শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তি দেখলে আপনার চোখে জল এসে যাবে। আমি ভাবতেই পারছি না যে আমাকেও একদিন মেয়েকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুয়ারে দুয়ারে এভাবে ঘুরতে হবে! এর একটা যথার্থ সমাধান প্রয়োজন।
কেউ কেউ বলছেন, ভর্তি পরীক্ষারই প্রয়োজন নেই। অনলাইনে আবেদন করবে, কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চায় সে রকম অপশন দেবে, ব্যস। ডিজিটালের যুগ, তার সদ্ব্যবহার কর। কিন্তু এর বিপরীতেও কথা আছে প্রচুর। অনেকেই মনে করেন, উচ্চশিক্ষার এ স্তরটি বিশেষায়িত। সুতরাং বিষয়ভিত্তিক একটু যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন আছে।
আমি এই কথা মেনে নিয়েই বলছি, বিগত ২৮ বছরের শিক্ষকতা-জীবনে এমন কী ই বা যাচাই করলাম যা বিশেষভাবে বলা যায়? ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে ‘বিষয়’ গুরুত্বের কথাটা আমার মনে ধরেছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রের যোগ্যতা পরিমাপের সঙ্গে রাজশাহী কিংবা চট্টগ্রাম অথবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পার্থক্য কতখানি? যে সিলেবাস অথবা কারিকুলাম ধরে পড়ান হয় তার মধ্যে পার্থক্য অতি সামান্যই।
কেননা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগেই সিলেবাস তৈরি হয় ‘কমিটি অব কোর্সেস’ দ্বারা। এ কমিটির সদস্য থাকেন স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে একাধিক অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ কথা রসায়ন-পদার্থ থেকে শুরু করে বাংলা-ইতিহাস সব বিভাগের বেলাতেই প্রযোজ্য। তাহলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেন্টার করে একটি মাত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা করা কি একবারেই অসম্ভব? যদি প্রকৌশল এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করি তারপরও অন্তত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদ্ধতিতে পরীক্ষার কাজটি করা যেতে পারে।
একজন শিক্ষার্থীর আবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়-পছন্দের অপশন থাকবে, বিভাগ- পছন্দের অপশন থাকবে আর থাকবে সেন্টার-পছন্দের অপশন (যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রযুক্তির পরম উৎকর্ষের যুগে এটি কি একটি অসম্ভব কাজ? আমি জানি যতটা সহজভাবে বলছি কাজটি হয়তো ততটা সহজ নয়, কিন্তু ভোগান্তির মাত্রা যে চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে? শিক্ষার্থী-অবিভাবকদের প্রতি দিনের পর দিন আমরা কি এহেন নির্মম আচরণ করতে পারি? বিষয়টি নিশ্চয়ই ভাবতে হবে এবং ‘ভোগান্তি” দূর করার একটা না একটা উপায় বের করতেই হবে।
হাজারো ভোগান্তি শেষে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়- বিভাগ ভেদে খরচ পড়ে ১১ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা। এতেই কি শেষ? না। গত বছরের প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির বিষয়ে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘ভর্তি ও আনুষঙ্গিক ফি’ বাবদ দেখা যায় ২৯টি খাত।
খাতগুলো হলো- শিক্ষাদান, ভর্তি/পুন. ভর্তি, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, তৈজষ পত্র, রশিদ বই, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ল্যাবরেটরি/কম্পিউটার ল্যাব. রক্ষণাবেক্ষণ, পরীক্ষার ফরম, রোভার স্কাউট/রেঞ্জার, বিএনসিসি, গ্রন্থাগার উন্নয়ন, কম্পিউটার সেন্টার, সংবাদপত্র/সাময়িকী/ কমনরুম, ভর্তি ফরম, ইন্টারনেট, ইন্টারনেট রক্ষণাবেক্ষণ, প্রক্টোরিয়াল সার্ভিস,কাউনসেলিং, জাতীয় দিবস উদযাপন, বৈদ্যুতিক, বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন, হল উন্নয়ন, শিক্ষা উন্নয়ন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন, ফেটাল ডিজিজ রিকোভারি ও পরিবহন। তালিকা দেখে একজন রসিকের মন্তব্য- ভিসি মহোদয়ের আবাসিক বাবুর্চির বেতন ফি বাদ পড়েছে! এটা শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ না, সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই চিত্র- ঊনিশ আর বিশ।
খাতগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে, একজন শিক্ষার্থী যে ডাল-ভাত খাবে তার থালা-বাসনের ভাড়াও তাকে দিতে হবে। বিশ্বাবদ্যালয়ের উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের দায় এখন শিক্ষার্থীদের। জাতীয় দিবস এবং ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের খরচাও শিক্ষার্থীকে দিতে হবে।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে চাই, অনেকেরই ধারণা ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রির টাকা বোধ করি পুরোটাই ‘মাস্টার’রা খেয়ে নেন। আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারকার ‘বি’ ইউনিটের একটি ক্ষুদ্র ক্ষতিয়ান দিই। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ফরম বিক্রির ৪০ শতাংশ নিয়ে নেবে বিশ্বাবদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ১৩ বিভাগ উন্নয়ন বাবদ তিন তের ৩৯ শতাংশ নেবে, ডিন অফিস নেবে ২ শতাংশ, প্রশ্নপত্র ছাপা এবং পরিদর্শকদের পারিতোষিক বাবদ ধরা যাক ১০ শতাংশ। হাতে থাকলো মাত্র ৯ শতাংশ যেটা শিক্ষকরা নেবেন। অর্থাৎ প্রশাসন এবং বিভাগ মিলে ভর্তি পরীক্ষার ৮০ শতাংশ টাকা নিয়ে নেয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে আমরা যে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’ বলি তা কি প্রকৃতই ‘পাবলিক’ নাকি ‘প্রাইভেট-পাবলিক ইউনিভার্সিটি (পিপিইউ)?’
শিক্ষার ব্যয়ভার রাষ্ট্রেরই বহন করার কথা এবং এ নিয়ে দু’চার কথা বলাও যায়। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্র-চরিত্রের রূপটি বিবেচনায় নিলে তা হবে ‘অরণ্যে রোদন’। এ দিকটি আপাতত বাদ দিলেও ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী-অবিভাবকদের নির্মম ভোগান্তির অবসানের পথ আমাদের খুঁজতেই হবে। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
সৌজন্যে: যুগান্তর