সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধে সাড়া নেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধে নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় সাড়া দিয়েছে। বাকিরা আগের মতোই চলছে। কেউ কেউ একটি কমিটি করে দিয়েই দায় সেরেছে। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে সন্ধ্যাকালীন কোর্স বহাল রাখা যায় সে ব্যাপারে ইউজিসিতে ধরনা দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় মূলত তাকিয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের দিকে। রোববার (১৯ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সন্ধ্যাকালীন কোর্স নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি। নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও এক শ্রেণির শিক্ষক কিন্তু ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তাঁরা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন।’
এর দুই দিন পর ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধে নির্দেশনা দেয় ইউজিসি। ওই দিনই এসংক্রান্ত চিঠি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পাঠানো হয়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করে ইউজিসি। কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা করায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ইউজিসির নির্দেশনার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধের ঘোষণা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিভাগগুলোকে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি না করাতে নির্দেশনা দেয়। তবে যেসব শিক্ষার্থীর কোর্স চলমান রয়েছে, সেগুলো যথারীতি শেষ করতে বলা হয়।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে এই কোর্স পরিচালনা করছে। বর্তমানে দুই সেমিস্টারে ৪০০ শিক্ষার্থী সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়ছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার বলেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। তবে আমাদের সিনেট, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’
সন্ধ্যাকালীন কোর্স সবচেয়ে রমরমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের ৪২টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ৮০টি সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু আছে। আর এতে পড়ছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিনে যেমন জমজমাট থাকে, সন্ধ্যাকালীন কোর্সের জন্য রাতেও একইভাবে জমজমাট থাকে। শিক্ষকরাও বিপুল আগ্রহে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে ক্লাস নিয়ে আসছেন। এমনকি এই কোর্স থেকে শিক্ষকরা অনেক বেশি টাকা পান বলে নিয়মিত কোর্সের চেয়ে অনেক শিক্ষক রাতের ক্লাসেই বেশি আগ্রহী। তবে নির্দেশনা জারির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধিদল বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে।
ইউজিসির নির্দেশনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত মে মাসে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের ব্যাপারে কমিটি করে দিয়েছি। তাদের প্রতিবেদনের পর আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো কাজ আমরা করব না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্ন নামে চালাচ্ছে সন্ধ্যাকালীন কোর্স। তারা প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার পরিচালনা করছে ‘উইকেন্ড কোর্স’। ইউজিসির নির্দেশনায় উইকেন্ড কোর্স বন্ধের কথা না লেখায় তারা নিশ্চিন্তে কোর্স চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদের নতুন কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির তোড়জোড়ও চলছে।
তবে ইউজিসি বলছে, উইকেন্ড কোর্স নামে যে কোর্স আছে সেটা তাদের জানা নেই। আর সন্ধ্যাকালীন কোর্স আর উইকেন্ড কোর্সের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বরং সন্ধ্যাকালীন কোর্সের চেয়ে উইকেন্ড কোর্সের শিক্ষার মান আরো বেশি খারাপ।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আমির হোসেন (প্রশাসন) বলেন, ‘ইউজিসি সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে; কিন্তু আমরা পরিচালনা করি উইকেন্ড কোর্স। তাই আপাতত কোর্সগুলো বন্ধের ব্যাপারে ভাবছি না। তবে ইউজিসি যদি উইকেন্ড কোর্স বন্ধের নির্দেশনা দেয়; তখন সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হারুন-উর-রশিদ আসকারী বলেন, ‘আমরাই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যারা সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালুর পর আবার বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তবে এরপর অনেক কড়া নিয়ম-কানুন করে আবারও এই কোর্স চালু করা হয়েছে। ইউজিসির নির্দেশনা আমরা অবশ্যই মেনে চলব। তবে আমরা একাডেমিক কাউন্সিল ও শিক্ষক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’
এসব বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির সঙ্গে সন্ধ্যাকালীন কোর্স যায় না। এ ছাড়া এই কোর্সগুলোর কোনো অনুমোদনও নেই। যেটা আমরা অনেক দিন ধরেই অনুভব করছিলাম। রাষ্ট্রপতিও এই কোর্সের ব্যাপারে বলেছেন। এরপর আমরা সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধের নির্দেশনা জারি করি। তবে আমাদের সরাসরি এই কোর্স বন্ধ করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু নির্দেশনা জারির পর থেকে আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানাব। তারাই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’
উইকেন্ড কোর্সের ব্যাপারে এই সদস্য বলেন, ‘উইকেন্ড কোর্স নামে যে কোর্স আছে তা আমরা জানতাম না। এখন সাত দিনের পড়া কিভাবে দুই দিনে হবে, সেটা আমাদের ধারণায়ই নেই।’