পুনঃনিরীক্ষণ নয়, খাতা পুনর্মূল্যায়ন হোক - দৈনিকশিক্ষা

পুনঃনিরীক্ষণ নয়, খাতা পুনর্মূল্যায়ন হোক

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর পিইসি, জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। সেদিন পরীক্ষার ফলের আনন্দে সারাদেশ উচ্ছ্বসিত ছিল। বিশেষ করে যে সব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের আনন্দ কে দেখে? তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকরা কম উচ্ছ্বসিত হননি। নানা মিডিয়ায় দল বেঁধে উচ্ছ্বাস ও মিষ্টিমুখ করানোর ছবি ভাইরাল হতে দেখা গেছে।

যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে কিংবা অন্যান্য গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে, তারা কি শিখেছে বা না শিখেছে সে নিয়ে কারো চিন্তা নেই। কেবল রেজাল্টই যেন সব। জিপিএ-৫ এর জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর কী যে নির্যাতন যাচ্ছে, সে খবর আমরা কয় জনে রাখি? ভালো ফলের জন্য মা-বাবার তাড়া, শিক্ষকদের তাড়া। কী এক অশুভ প্রতিযোগিতায় ফেলে আমরা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাথা খেয়ে ফেলছি, সেদিকে খেয়াল নেই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি উপলব্ধি করে বলেছেন যে, ‘জিপিএ-৫ এর চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিতে হবে’। শিক্ষামন্ত্রীর এ মন্তব্যকে স্বাগত জানানো উচিত।

যারা জিপিএ-৫ পাবে বলে বড়রা আশা করেছিল, অথচ তারা পায়নি; ফল প্রকাশের পর না জানি কত জনের কত তিরস্কার ও ভর্ৎসনা তাদের সহ্য করতে হয়েছে। অন্যদিকে যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের অনেকের শিক্ষক ও অভিভাবক জিপিএ পেতে কত অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন, তা কেবল তারাই জানেন। এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বেশ কয়জন শিক্ষার্থী অনৈতিক কাজ করায় পরীক্ষা থেকে বহিষ্কার হয়। মাননীয় হাইকোর্ট তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আদেশ দিয়ে পুনরায় তাদের পরীক্ষা নেবার কথা বলেছেন। আমাদের কথা হলো, এসব কোমলমতি শিশুদের অনৈতিক কাজ করতে কারা উৎসাহিত করেছে? যে করে হউক সর্বোচ্চ জিপিএ হাতিয়ে নেবার জন্য আমরা বড়রা কেউ না কেউ এদের অনৈতিক পথ দেখিয়েছি। এভাবে আমরা নতুন প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছি। এ কাজটি কতটুকু ঠিক হচ্ছে? জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য আমরা শিশুদের যতটুকু চাপের মধ্যে রেখেছি, তাদের মানুষ করার ততটুকু চেষ্টা কি আমাদের মধ্যে আছে?
 
বিগত বছরগুলোর ন্যায় এ বছরও জানুয়ারি মাসের প্রথমদিনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া হয়েছে। নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীদের সে কী আনন্দ! নতুন বইয়ের গন্ধে মাতোয়ারা হয়েছে কোটি শিক্ষার্থীর কঁচি মন। বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেবার মতো ভালো কাজ আর কী হতে পারে? আমরা যখন লেখাপড়া করেছি, তখন মার্চ-এপ্রিলের আগে টাকা পয়সা দিয়েও বই কিনতে পাওয়া যেত না। পুরাতন বই কেনা-বেচা হতো। অনেকেই আমরা পুরনো বই কিনে পড়েছি। কখনো পুরো সেট। কখনো আংশিক। এখন পড়ালেখায় পুরানো বইয়ের কোনো কায়-কারবার নেই। সব নতুন বই। ঝকঝকে মলাট আর চকচকে বইয়ের পাতা। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেকের চেয়ে আমরা বেশ এগিয়ে।

বছরের শেষদিন পরীক্ষার ফলের আনন্দ আর পরের দিন বছর শুরুর দিনে নতুন বইয়ের আনন্দ মিলে বলা যায় দু’দিন দেশে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছে। আনন্দের জোয়ারে পুরো দেশ ভেসেছে। সারাবছরের ৩৬৫ দিন এমন খুশি লেগে থাকলে কত মজাই না হতো। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম অন্য রকম। হাসি-খুশি আর দুঃখ-বেদনা মিলে কেটে যায় একেকটি বছর। এভাবেই কেটেছে-২০১৯। এ রকমই কেটে যাবে-২০২০। এ মতো করে জীবন এগিয়ে যায় জীবনের স্থায়ী ঠিকানার দিকে। এখন থেকে প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর ছোটদের বড় পরীক্ষার ফল বের হলে বছরের শেষ ও শুরুর দুটো দিন অন্তত আনন্দে অতিবাহিত করা যাবে। ১ জানুয়ারি বই উৎসব নির্ধারিত আছে। ৩১ ডিসেম্বর পরীক্ষার ফল উৎসব পালন করা যায় কিনা, ভেবে দেখা যেতে পারে।

যে বিষয়টি নিয়ে আজকের লেখা শুরু করেছিলাম সে কথাটি বলাই হয়নি। পরীক্ষার ফল বেরুনোর পর খাতা পুনঃনিরীক্ষণের বিষয়ে দু’ চার কথা আগেও দু’ এক জায়গায় লিখেছি। আজ আবার লেখার প্রয়োজন অনুভব করছি। ফল বের হবার পর পরই পুনঃনিরীক্ষণের জন্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কর্তৃপক্ষের দিক থেকে এক রকম উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। পথ বাতলে দেয়া হয়। সিস্টেম জানিয়ে দেয়া হয়। প্রতি বিষয়ের জন্য একশ থেকে দেড়শ টাকা ফি নির্ধারণ করা থাকে। তারপর কী করা হয়, সে কথাটি অনেকে জানে না। পরীক্ষার খাতায় প্রাপ্ত নম্বরের যোগ-বিয়োগ সঠিক কি-না কেবল তাই পুনঃনিরীক্ষণে যাচাই করে দেখা হয়। 

প্রকৃতপক্ষে, খাতা যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়েছে কিনা, পরীক্ষক সঠিকভাবে খাতা দেখে নম্বর প্রদান করেছেন কিনা- তা পুনরায় যাচাই করে দেখা হবে মনে করে পরীক্ষার ফলে হতাশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আবেদন করে থাকেন। ফিও দিয়ে থাকেন। কিন্তু যা মনে করে ফল পরিবর্তনের আশায় আবেদন করা হয়, তার কিছুই করা হয় না। শুধু পরীক্ষক কর্তৃক প্রদেয় নম্বরের যোগফল সঠিক হয়েছে কিনা, কেবল সেটুকুই দেখা হয়। প্রকৃতপক্ষে আবেদনকারী শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক কেবল এটিই চান না। এর জন্য তারা আবেদন করেন না। তারা চান, দ্বিতীয় কোনো পরীক্ষক পুনরায় খাতাটি যেন মূল্যায়ন করেন। দ্বিতীয় পরীক্ষকের মূল্যায়নের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার আশায় তারা আবেদন করে থাকেন। কেবল প্রদত্ত নম্বরের যোগফল সঠিক কিনা তা জানার জন্য কেউ আবেদন করেন না। যোগ-বিয়োগে তাদের কোনো অনাস্থা নেই। খাতা মূল্যায়নে তাদের অনাস্থা। তারা মনে করেন, যিনি খাতা দেখেছেন তিনি সঠিক কিংবা যথার্থ খাতা মূল্যায়ন করতে পারেননি বলে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হয়নি। দ্বিতীয় কোনো পরীক্ষক খাতা দেখলে সঠিক মূল্যায়ন হবে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হবে।

কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যা ভেবে আবেদন করে থাকেন সে মতো কাজ করা উচিত বলে আমরা মনে করে থাকি। কেবল নম্বর যোগ করে দেখার জন্য এত টাকা ফি নেবার দরকার পড়ে না। খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য ফি আরেকটু বাড়িয়ে নিলেও অসুবিধা নেই। এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলোর নির্দেশনা পরিবর্তনের এখনই উপযুক্ত সময়। তা না হলে এক সময় আর কেউ এজন্য আবেদন করতে চাইবে না। এ রকম হলে আবেদন করে কী লাভ?

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038120746612549