অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমার কাছে শুধু মেলাই নয়, একটা উত্সবও বটে। এই উত্সব শুধু বইকে ঘিরে। মাঝখানে আর কিছু নেই। সবচেয়ে বড়কথা এই উত্সব সার্বজনীন। মেলার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন। সবকিছু মিলিয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন। সারাবছর এই মেলাটির জন্য অপেক্ষায় থাকি। মেলায় এমন অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়, যাদের সঙ্গে সারাবছর আর কোথাও দেখা হয় না। আবার এমন অনেকেই আছেন যাদের সান্নিধ্য খুব উপভোগ করি। লেখক বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আড্ডাও হয়। এরই ফাঁকে নতুন বইয়ের খবরও রাখি।
কোথায় কোনো বইটি এলো। গল্প উপন্যাসের চেয়ে মননশীল বইয়ে আমার ঝোঁক বেশি। মেলায় ঘুরে এধরনের বই সংগ্রহ করি। সংগৃহীত বইগুলোই সারাবছর পাঠের রসদ যোগায়। মেলায় সবচেয়ে উন্মুখ থাকি নিজের লেখা নতুন বইয়ের জন্য। আমি কেন, সব লেখকের কাছেই বই সন্তানতুল্য। কারণ বইয়ের প্রতিটি শব্দেরই স্রষ্টা তিনি। একটি বইয়ের জন্য আমাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। দুই মলাটের একটি বই অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে তবেই না আলোর মুখ দেখে। তবে মেলায় মানসম্পন্ন মননশীল গ্রন্থের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। সিরিয়াস বইগুলো আরো সিরিয়াসভাবে দেখা প্রয়োজন। আগের তুলনায় এখন প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক বইয়ের পাঠক অনেক বেড়েছে। তবে সে তুলনায় লেখকের সংখ্যা বাড়েনি। তাছাড়া প্রচারণার অভাবে এধরনের বইয়ের খবরও পাঠকরা জানতে পারেন না। প্রকাশকরা এক্ষেত্রে আরেকটু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
বই মেলা এখন সম্প্রসারিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবছরই মেলার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ভিড়, ধাক্কাধাক্কি থাকলেও তাতে প্রাণের একটা স্পর্শ ছিলো। একটা সুর ছিলো। এখন বর্ধিত অবয়বে সেই সুরের তাল-লয় যেন কিছুটা কেটে গেছে। যদিও মেলার পরিধি বাড়ানো নিয়ে লেখক-প্রকাশকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো। এ বছর নতুনভাবে যুক্ত হলো ‘লেখক বলছি মঞ্চ। এই মঞ্চে প্রতিদিন পাঁচজন প্রতিনিধিত্বশীল লেখক সাহিত্যের বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
মেলার তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ক্রয়যোগ্য নির্বাচিত নতুন বইয়ের একটা ছক তৈরি করি। স্টলে ঘুরে ঘুরে নতুন বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। ভালোই লাগে। শেষ সপ্তাহে সেই বইগুলো কিনতে শুরু করি। ধীরে ধীরে মেলায় বিদায়ের সুর বেজে ওঠে। আমরা বিষণ্ন হয়ে উঠি। একধরনের হাহাকার আচ্ছন্ন করে।
শেষ কথা হলো, একুশ যেহেতু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেহেতু মেলাটি এখন জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। তাহলে সারা বিশ্বে ভাষা শহীদদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে।
লেখক: প্রকৃতি বিষয়ক লেখক
সৌজন্যে: ইত্তেফাক