সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশকে পোহাতে হচ্ছে একই দুর্ভোগ। উপরন্তু, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ঝুঁকির আশঙ্কা অন্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ইতিমধ্যে যা অনেকটা দৃশ্যমান হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে যখন-তখন আঘাত হানছে ঝড়, নিম্নচাপে উত্তাল হচ্ছে সমুদ্র। গাছপালা কমে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণও। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে সৃষ্টি হচ্ছে বজ্রপাত। শঙ্কার বিষয় হলো, বাংলাদেশে বজ্রপাতের সংখ্যা দিনকে দিন ক্রমেই বাড়ছে। ফলে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এখন বর্ষাকাল; বৃষ্টির মৌসুম। গ্রীষ্ম ও বর্ষার চার মাসে বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ে তুলনামূলক অনেক বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। প্রতিবছর সারাবিশ্বে যত মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারায়, তার প্রতি চারজনের একজন বাংলাদেশে। এতেই বোঝা যায়, কতটা ঝুঁকিতে রয়েছি আমরা। দুঃখজনক হলেও অস্বীকারের উপায় নেই, এই বৃদ্ধির জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী আমরাই। আর এর মধ্যে প্রধান হলো নির্বিচারে বৃক্ষনিধন। এমন একটা সময় ছিল, যখন দেশের বেশির ভাগ এলাকায়, বিশেষ করে গ্রামে বড়ো বড়ো গাছ থাকত। বিশেষত তাল, খেজুর, নারিকেলসহ নানা ধরনের বড় গাছ। আর এসব গাছ প্রাকৃতিক ঢাল হয়ে বজ্রপাতের বিপক্ষে লড়াই করত। কিন্তু এখন আর সেই সব গাছ খুব একটা দেখা যায় না। কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে, মোবাইল টেলিফোনের টাওয়ার থেকে নিঃসৃত অদৃশ্য তরঙ্গ স্লো পয়োজন হয়ে শেষ করে দিচ্ছে তাল, নারিকেলের মতো লম্বা গাছকে; যা আমাদের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে বিবেচিত। কোনো সন্দেহ নেই, গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায়, বিশেষ করে বড়ো গাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। এছাড়া বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই অকালমৃত্যুকে নীরবে মেনে নেওয়া ছাড়া যেন কোনো গত্যন্তর নেই। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। কারণ চেষ্টা করলেই সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব। আর সে ক্ষেত্রে বজ্রপাত প্রতিরোধে প্রাথমিক কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতা। বজ্রপাত শুরু হলে বা শুরুর সম্ভাবনা দেখা দিলে খোলা মাঠে বা খোলা জায়গায় থাকা যাবে না। কারণ ফাঁকা জায়গা ও উঁচু গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি ইত্যাদিতে বজ্রপাত আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বজ্রপাতের সময় এসব জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে।
বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় সাধারণত বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ, ল্যান্ড টেলিফোন লাইনের তার স্পর্শ করা উচিত নয়। বজ্রপাতের সময় অবশ্যই বৈদ্যুতিক সংযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বজ্রপাতের সম্ভাবনা দেখলেই টিভি, ফ্রিজ বন্ধ করে দিতে হবে এবং এসব যন্ত্রপাতির বৈদ্যুতিক প্লাগ খুলে রাখতে হবে। বজ্রপাতের সময় কেউ যদি গাড়ির মধ্যে থাকেন, সম্ভব হলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে নিরাপদ কোনো স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। বজ্রপাতের সময় খালি পায়ে থাকাও খুবই বিপজ্জনক। এছাড়া ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক হতে হবে। বাড়িতে অবশ্যই বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা প্রয়োজন।
প্রতিরোধ নিয়েও দুকথা বলা প্রয়োজন বৈকি। বজ্রপাত প্রতিরোধে আমাদের শুরু করতে হবে সবুজের অভিযান। কারণ গাছই হতে পারে এ ক্ষেত্রে আমাদের সত্যিকারের বন্ধু। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে তাল, নারিকেল ও খেজুরগাছ লাগানোয়। কারণ এসব গাছ বজ্রপাত প্রতিরোধ করতে সক্ষম। আর রাস্তার পাশে তা হতে পারে সহজেই। পাশাপাশি বড়ো বড়ো বৃক্ষ রোপণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি উদ্যোগও কার্যকর হতে পারে।
বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনকেও উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। যেহেতু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং শহরাঞ্চলে গাছের ডালপালা ছেঁটে ফেলায় বজ্রপাতের ঝুঁকি বেড়েছে, তাই মোবাইল ফোনের টাওয়ার ছাড়াও যেসব টাওয়ার বেশ উঁচু, সেগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর্থিংয়ের মাধ্যমে বজ্রপাত প্রতিরোধের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই তাপমাত্রা বেড়েছে; এটা আর কিছু নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। তাই প্রকৃতির পরিচর্যায় সম্ভব শঙ্কাহীন ভবিষ্যত্ গড়ে তোলা।
লেখক : সাংবাদিক
সূত্র: ইত্তেফাক