শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে প্রজন্মের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত স্পষ্ট করে পথনির্দেশনা দিয়েছে। তাদের আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে সহমত তো পোষণ করিই, একই সঙ্গে এও মনে করি যে, তাদের এই আন্দোলন থেকে শেখারও আছে অনেক কিছু। মানুষের ভালোবাসা আদায় থেকে শুরু করে, সমর্থন অর্জন পর্যন্ত কীভাবে করতে হয় তাও তারা শিখিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের নায্য দাবির এই আন্দোলনে হামলা চালানো হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছিল শিক্ষার্থীরা। হঠাৎই লাঠি হাতে তাদের দিকে তেড়ে আসে পুলিশ। ঠিক তখনই লাঠিসোঠা নিয়ে একদল যুবক পুলিশের সঙ্গে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। ঘটনাটি ঘটেছে ২ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর এলাকায়। ৩ আগস্ট একটি পত্রিকার শীর্ষে এই ছবিটি প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশকে না হয় চেনা গেল; কিন্তু লাঠিধারী ওই যুবকরা কারা? এরা পুলিশের সঙ্গে মিলেমিশে শিক্ষার্থীদের ওপর কেন হামলে পড়ল?
ভুল ইতিমধ্যে অনেক হয়েছে। ভুলের সীমানা আর বিস্তৃত না হলেই মঙ্গল। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের ইস্যু আর দশটা আন্দোলনের ইস্যুর মতো নয়। এর সাম্প্রতিক কারণ যেমন খুব মর্মন্তুদ এবং তা একদিনে পুষ্টও হয়নি। একাধিক মর্মন্তুদ ঘটনার এ হলো প্রতিফল। প্রতিটি ঘটনায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে এক ধরনের অনাস্থারও প্রকাশ ঘটেছে। তারা দায়িত্বশীলদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। তারা বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমেছে, কিন্তু কোনো উচ্ছৃখলতা প্রদর্শন করছে না। বরং অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, শিখিয়ে দিচ্ছে। আইনি সংস্থা, সরকারের লোকজনকে বুঝিয়েও দিচ্ছে। তাদেরও কেউ কেউ চলেছেন বেআইনি পথে। মানুষ মারা যায় রাস্তায় দুটি বাসের চালকের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আর সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী দায়িত্বজ্ঞানহীন (যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চেয়েছেন) মন্তব্য করেন! তার এমন আচরণ ক্ষুব্ধ-ব্যথিতদের বুকের আগুন আরও দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিকদের প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছে শিখে নেওয়ার আছে অনেক কিছু।
আমাদের সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য চলছে। যাত্রী মেরে পানিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ দু'জন শিক্ষার্থীকে বাসচাপা দিয়ে মেরে ফেলা হলো। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গত বৃহস্পতিবার ছুটি ঘোষণা করল। ওই দিন আবহাওয়াও খারাপ ছিল। কিন্তু ছুটি-বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে রাজপথে নেমে এলো শিক্ষার্থীরা, যাদের সিংহভাগই কোমলমতি। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। এতদিন ধরে আমরা যা করতে পারিনি তারা তা করে দেখিয়েছে। তারা এও শেখাল যে, এদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নিয়ম রক্ষা করা সম্ভব। তারা আমাদের অনেক ব্যাপারেই পথনির্দেশনা দিয়েছে। তারা যা করেছে এতে তারা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। শিক্ষার্থীরা কি ঘুম ভাঙাতে পেরেছে দায়িত্বশীলদের? তবে তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা চলবে না। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন- এও তারা স্পষ্ট করে মনে করিয়ে দিয়েছে। তাদের বার্তাগুলো আমলে নিতে হবে। এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতাবান, স্বেচ্ছাচারীদের তারা মানবে না। তাদের বিবেক স্বচ্ছ। তারা সুনীতির যেমন চর্চা করে, তেমনি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও পোষণ করে। তাদের সব বার্তাই খুব স্পষ্ট।
মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা সহপাঠী হত্যার বিচার এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামার পর তাদের আন্দোলন শুধু আর এখন ওই দুটিতেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের দাবির মধ্যে আছে নিরাপত্তা এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার অনেক বিষয়। এই আন্দোলনকে শক্তি প্রয়োগ করে দমনের চেষ্টা করা হলে তা বড় ধরনের ভুল হবে। অনেক দিন ধরেই অভিযোগ উঠছে সড়ক-মহাসড়কে যা ঘটছে এর সবটাই দুর্ঘটনা নয়, এর অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে আছে বহু রকমের হীনস্বার্থ। গণপরিবহন ব্যবস্থার চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ও এ বিষয়ে সরকারের নির্লিপ্ততার ফলে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মানুষ এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত পথ দেখাতে পথে নেমে এসেছে শিক্ষার্থীরা। অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থার দায়িত্ব তারা নিজ হাতে তুলে নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটা শুধু দায়িত্বশীলদের জন্য লজ্জারই নয়, এই অনাস্থার বিষয়টি উদ্বেগেরও বটে। নিরাপদ সড়কের দাবি জনদাবিই বটে। এই দাবি পূরণের সব রকম পদক্ষেপ সরকারকে অনতিবিলম্বে নিতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নির্মোহ অবস্থান নিতে হবে। পরিকল্পনাহীনতা ও অব্যবস্থাপনায় পুঞ্জীভূত কুফল হলো সড়ক-মহাসড়কে প্রাণঘাতী নৈরাজ্য। এই নৈরাজ্য ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা দরকার।
সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার কারণগুলো অচিহ্নিত নয়। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত আলোচনা-পর্যালোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনো কিছুই কম হয়নি। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই। লাইসেন্স প্রদান থেকে শুরু করে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান পর্যন্ত স্তরে স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি। আবার সিংহভাগ ক্ষেত্রে এর কোনো কিছুই নেই! রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি অবনতির দিকে নিয়ে গেছেন। তাদের কেউ বলেছেন চালকদের পড়াশোনা জানার দরকার নেই। কেউ বলেছেন দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই ইত্যাদি। জবাবদিহিতা কার আছে। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই উন্মোচিত হয়েছে। ওরা নিঃস্বার্থভাবে পথে নেমেছে। তাদের মধ্যে মুনাফার লোভ নেই। তারা সবার জীবনের নিরাপত্তার দাবি নিয়ে পথে নেমেছে। তারা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, আইনের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন হোক। যারা আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য রাস্তায় নেমেছে। ওরা রাজনীতি করে না, রাজনীতি বোঝে না। ন্যায় ও সত্য এদের লক্ষ্য। সৎ উদ্যোগ এদের শক্তি। এদের রাস্তায় দাঁড়ানোর কথা ছিল না। গাড়ির লাইসেন্স দেখা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চিহ্নিত করা এদের কাজ কিংবা দায়িত্ব নয়। তারা বাধ্য হয়ে এসব কাঁধে তুলে নিয়ে দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এবারও যদি দায়িত্বশীলরা ব্যর্থতার গণ্ডি ভেদ করে বের হয়ে আসতে না পারেন, তবে ভবিষ্যতে আরও মূল্য দিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টিকে সরকারের দায়িত্বশীল অনেকেই বিরোধী পক্ষের রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে চাইছেন। এক্ষেত্রেও তারা ভুল করছেন। কয়েকদিন ধরে যে বিক্ষোভ শিক্ষার্থীরা করছে এটাকে শুধু বিক্ষোভ হিসেবে দেখলে চলবে না। এর সঙ্গে সারাদেশের মানুষের ক্ষোভ মিশে আছে। মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তবুও মানুষ চলমান আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে। এর যৌক্তিকতা আছে। কারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। সরকার ও সরকারের কর্তৃপক্ষের বিষয়গুলো এবার সেভাবেই আমলে নেওয়া উচিত। পরিবহন মালিক-শ্রমিক জোট যাতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে না পারে সেদিকে সরকারের সতর্ক নজর রাখা উচিত। শিক্ষার্থীরা ধর্মঘট ডাকেনি, তারা অনিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা উচিত, চলমান আন্দোলনের দাবি অত্যন্ত মানবিক। আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, পরিবহন সংশ্নিষ্টরা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও অতীতে আন্দোলন করেছে। তবে আমরা আশায় বুক বাঁধি। আমাদের সন্তানরা আমাদের হারতে দেবে না। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেবে। তারাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত দেশ গড়বে। তারাই আমাদের পৌঁছে দেবে গন্তব্যে। তাদের উদ্দেশে বলব, এখন তোমরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাও। তোমরা তোমাদের সব বার্তা দিয়ে দিয়েছ। এবার সরকারের দায়িত্ব জনদাবি আমলে নিয়ে বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিয়ে আত্মতৃপ্তির নানারকম কথা শোনা গেলেও সড়ক নিরাপত্তার চিত্র সম্পূর্ণ এর বিপরীত। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। এবার এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিল শিক্ষার্থীরা। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার কারণগুলো অচিহ্নিত নয়। এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও এর প্রতিকার নিশ্চিত না করাতে পারার কারণগুলোও সচেতন মানুষের অজানা নয়। সড়ক দুর্ঘটনা উন্নত দেশেও হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো এ হার এত উচ্চ কি-না এবং এমন প্রতিকারহীন কি-না এগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। দুর্ঘটনা যেহেতু মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ এবং বোধগম্য কারণ ছাড়াই আকস্মাৎ ঘটতে পারে সেহেতু অনেক সময় দুর্ঘটনাকে অসহায়ভাবে না মেনে উপায় থাকে না মানুষের। কিন্তু আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে কিছু মানুষের দায়িত্বহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, হীনস্বার্থ এমন বিষয় ক্রমেই নগ্নভাবে ধরা পড়ছে। ফলে সহিষ্ণুতার সীমা ভেঙে সমাজে দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভের প্রকাশ শেষ পর্যন্ত এ রূপ নিয়েছে। কোনো খাতে অনিয়ম যদি নিয়ম হয়ে যায়, তখন সেই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের পরিবহন খাতের অবস্থাটা হয়েছে সে রকমই। কাজটা কঠিন হলেও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে যত রকম ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সে সবই করতে হবে কঠোর অবস্থান নিয়ে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল থামাতেই হবে।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: সমকাল