আমার একটি বিশেষ পরিচয় আছে। আমি একজন প্রতিবন্ধী সন্তানের জননী। এই পরিচয় আমি বহুবার উচ্চারণ করেছি। সন্তানের পরিচয় দিতে আমি কখনও দ্বিধা করি না বরং গৌরব অনুভব করি। আমি মনে করি, হয়তো আমার এই সন্তানের জন্যই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় কাজ করার ক্ষেত্রে আমার বিশেষ একটি তাগিদ আছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, কর্মশালা, বেতার-টেলিভিশনে টক শোতে যখনই এ ধরনের প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছে, আমি আমার বড় ছেলে নাসিফের কথা বলেছি। তবে তার অটিজম আছে- এ পরিচয়টি একটি বড় প্ল্যাটফর্মে দেওয়ার প্রথম সুযোগ আসে, যখন যুগ্ম সচিব হিসেবে আমার পদোন্নতির পর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন হয়। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
সহকর্মীদের অনেকেই মনে করেছিলেন, আমার ডাম্পিং পোস্টিং হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি ছিল আমার জন্য আশীর্বাদ। দায়িত্বভার গ্রহণের দুই মাসের মাথায় ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের ২ তারিখ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। ২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমার জানামতে, বিশ্বে এই একটিই দিবস, যার সঙ্গে সচেতনতা শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। আগে মানুষ অটিজম বিষয়ে তেমন একটা সচেতন ছিল না। অটিজমে আক্রান্তদের অনেকেই পাগল মনে করত এবং তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করত। মানুষের এই ভুল ধারণা ভাঙানোর জন্যই বিশ্বব্যাপী বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অটিজম সচেতনতা বিষয়ে বাংলাদেশের আয়োজন বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। আমাদের সৌভাগ্য, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন বিশ্বে অটিজম সচেতনতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাকে গ্লোবাল অ্যাম্বাসাডর অন অটিজম বলা হয়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের ২০০৯ সালের অনুষ্ঠানটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। স্বাগত ভাষণ দেওয়ার সময় আমি আমার বড় সন্তানের অটিজম আছে- এ বিষয়টি জানান দিই। তখন আমার একজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর মন্তব্য- এই ভরা সভায় আমার প্রতিবন্ধী সন্তানের পরিচয়টি যে দিলাম; তা বুঝে বললাম, নাকি না-বুঝে বললাম। অনুষ্ঠান শেষে আমি স্যারের কাছে গিয়ে বলেছিলাম, বুঝেই বলেছি। কারণ আমার ছেলের অটিজম থাকাটা আমার বা আমার ছেলের কোনো অপরাধের দায়ে ঘটেনি। আমার সন্তানের সুরক্ষাসহ বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। সে তার অধিকার চাইতে পারছে না। তাই তার অধিকারের কথা আমার বলতেই হবে।
এ কথার পর স্যার অনেকক্ষণ আমার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে ছিলেন। কারণ আমাদের সহকর্মী অনেকেই আছেন যারা প্রতিবন্ধী সন্তানের পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করেন এবং তা গোপন রাখেন। তারা হয়তো মনে করেন, তাদের এই প্রতিবন্ধী সন্তানের পরিচয় জনসমক্ষে প্রকাশিত হলে সমাজে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে; তারা হেয় প্রতিপন্ন হবেন। অনেকেই হয়তো ভাবেন, তিনি যেন কী পাপ করেছেন; সে জন্য আল্লাহতায়ালা তাকে এই শাস্তি দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ভাবেন, কারও অভিসম্পাতের ফলে তার পরিবারে এ ধরনের সন্তানের জন্ম হয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। কারণ প্রতিবন্ধিতা শুধু আমাদের সন্তানদেরই আছে, এমন নয়। প্রতিবন্ধিতা জীববৈচিত্র্যের একটি অংশ। বিশ্বজুড়েই প্রতিবন্ধী মানুষ আছে, ছিল এবং থাকবে।
আমরা অনেক প্রতিবন্ধী মানুষের কথা জানি, যাদের হাত নেই বা পা নেই। আবার অনেকের হাত-পা কোনোটিই নেই। কারও কারও দৃষ্টিশক্তি নেই বা শ্রবণশক্তি নেই; কিন্তু তাদের মস্তিস্ক সচল। তাদের অনেকের মস্তিস্ক আমাদের সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে। সঙ্গে থাকে তাদের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি। তারা সেই প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির বলে, নিজ নিজ লক্ষ্য অনুযায়ী নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে তারা অপ্রতিবন্ধী মানুষদেরও অতিক্রম করে। এখানে একটি মানুষের উদাহরণ দিতে চাই। তিনি হলেন নিক ভুজিসিক; হাত-পা ছাড়াই যার জন্ম। তার এই শারীরিক ত্রুটি দেখে বাবা স্তম্ভিত। জন্মের চার মাস পর্যন্ত মা তাকে কোলে তুলে নেননি। প্রচণ্ড অবহেলায় নিক বড় হন। ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন, এই শারীরিক ত্রুটি নিয়ে নিকের জীবনে কিছুই হওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু নিক তার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির বলে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। নিকের বাম কোমরে দুই আঙুলবিশিষ্ট একটি অপরিণত পা রয়েছে। এই দুটি আঙুল দিয়ে নিক এত দ্রুত টাইপ করতে পারেন, যা অনেক স্বাভাবিক মানুষও পারে না। মিনিটে তিনি ৪৭টি শব্দ টাইপ করতে পারেন। এই অপরিণত পা দিয়েই ভারসাম্য রক্ষা করে চলাফেরা করেন। তিনি দুই আঙুল দিয়েই ২১ বছর বয়সে ফিন্যান্সিয়াল প্ল্যানিং ও অ্যাকাউন্টিংয়ের মতো বিষয় নিয়ে দু'বার স্নাতক সম্পন্ন করেছেন 'গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে। নিক বলেছেন, 'আমি উঠে দাঁড়ানোর জন্য শতবার চেষ্টা করব। যদি শতবারই ব্যর্থ হই, তবুও ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সেটা ছেড়ে উঠব না। আমি আবার চেষ্টা করব এবং বলব, এটাই শেষ নয়।' তিনি পাঁচ উপমহাদেশের ষাটটি দেশ ঘুরে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের কাছে তার নিজের অসামান্য বক্তব্য পৌঁছে দেন। যে কেউ ইচ্ছা করলেই গুগলে সার্চ দিয়ে নিক ভুজিসিকের জীবনের সফলতার চিত্র দেখে নিতে পারেন। এভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী এমন হাজারো জনের সফলতার গল্প আমরা জেনে নিতে পারি।
আমরা এতক্ষণ শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের কথা আলোচনা করলাম। কিন্তু মস্তিস্কের বিকাশে যাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাদের বিষয়টিও আলোচনায় আসা প্রয়োজন। তাদের নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশেষ করে যাদের অটিজম আছে, মস্তিস্কের বিকাশের সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের অনেকেই মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। অটিজমের কিছু অনুষঙ্গ রোগ থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ইপিলিপসি বা খিঁচুনি। ওষুধপত্রের মাধ্যমে যা কমিয়ে রাখা যায় কিন্তু নির্মূল করা যায় না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিলে তারাও মূলধারায় আসতে পারে। তাদের অনেকেই ছবি আঁকা, সঙ্গীতসহ বিভিন্ন অঙ্গনে সফলতার প্রমাণ রেখেছেন। আমি দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনকালীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়েছি।
শিক্ষা সফরে প্রতিবন্ধীবিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছি। বিশেষ করে জাপান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। শিক্ষণীয় অনেক কিছুই নিজ দেশে প্রয়োগের চেষ্টা করেছি। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র চলমান। এসব কেন্দ্রকে প্রতিবন্ধী মানুষের হাসপাতাল মনে করা হয়। এখান থেকে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রয়োজনের আলোকে সব ধরনের থেরাপি সেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রতিটি কেন্দ্রে একটি অটিজম রিসোর্স সেন্টার আছে। এ কেন্দ্রের মাধ্যমে তৃণমূলের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অভিভাবকদের প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে কিছু প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়।
মাতৃগর্ভে বিভিন্ন জটিলতার কারণে অনেক সময় প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়। আবার অনেক সময় মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও কর্মকাণ্ডের কারণে কোনো কোনো সুস্থ মানুষও প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হন। তাদের নিয়মিত যত্ন ও পরিচর্যা এবং ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে মূলধারায় আনা অনেকটা সহজ হয়। এ জন্য বাবা-মা অভিভাবকের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে অনেক বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি কোনো রকম অবহেলা বা অতি যত্ন-পরিচর্যায় পরনির্ভর না করে তাদের স্বনির্ভর, কর্মক্ষম ও সুখী জীবনযাপনের জন্য তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। আমি বিশ্বাস করি, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করা যায়। জয় করা যায়, লক্ষ্য অর্জন করা যায়। যাদের দৃঢ় মনোবল আছে, তাদের কাছে প্রতিবন্ধিতা কোনো প্রতিবন্ধকতাই নয়। আর আমাদের যাদের সামর্থ্য আছে, সেবা করার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তাদের পাশে, যাদের পাশে আসলেই থাকা প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, 'সমাজসেবা যে জন করে, পা বাড়ালেই পুণ্য বাড়ে।' তাই আমার নিরন্তর প্রার্থনা- সুস্থ অবস্থায় মৃত্যু চাই। আর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকতে চাই।
লেখক: নাছিমা বেগম, সাবেক সিনিয়র সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়