প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজেরই অংশ - দৈনিকশিক্ষা

প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজেরই অংশ

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

প্রতিবন্ধী বলতে বোঝায় যারা জন্মগতভাবে অথবা রোগাক্রান্ত হয়ে বা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বা অপচিকিৎসার কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হওয়ার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম। আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী দেখা যায়। যেমন, দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, শ্রবণ-প্রতিবন্ধী, বাক-প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী ইত্যাদি।

অতীতে আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল প্রতিবন্ধিতা একটি বংশগত রোগ। সম্পূর্ণ সুস্থ দম্পতির ঘরেও প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিতে পারে। প্রতিবন্ধী শিশুকে অনেকে বাবা-মায়ের অভিশাপ বলে মনে করেন, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল এবং ভিত্তিহীন। প্রতিবন্ধিতার সঠিক কারণ আমাদের জানা না থাকলেও কোনো ব্যক্তি প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে তাকে প্রাথমিক প্রতিবন্ধিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মায়ের বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে অথবা ৩০ বছরের উপরে হয় এবং গর্ভাবস্থায় মায়ের যদি পুষ্টির অভাব দেখা দেয় বা প্রথম তিন মাসের মধ্যে যদি মা কড়া ঔষধ বা কীটনাশক বা ভেজাল বা বিষাক্ত খাবারগ্রহণ করে থাকেন বা গর্ভধারণকারী মায়ের যদি হাম, হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত জটিলতা বা ডায়াবেটিস থেকে থাকে, গভাধারণকারী মা যদি মদপান, ধূমপান, তামাক সেবন ইত্যাদির প্রতি যদি আসক্তি থাকে, প্রসবের সময় অব্যবস্থাপনা, যেমন-সঠিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা, মাথায় আঘাত পাওয়া, প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব থাকা, মস্তিষ্কে ইনফেকশন বা অন্য কোনো রোগ বা টিউমার হওয়া ইত্যাদি কারণে সন্তান প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে। তাছাড়াও রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো আত্মীয়র সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক বা উচ্চ মাত্রার জ্বর, বিষক্রিয়া, মস্তিষ্কের কিছু কিছু প্রদাহ বা অসুখ, টিউমার, পুষ্টি বা ভিটামিন বা আয়োডিনের অভাব ইত্যাদি থাকলে প্রাথমিক প্রতিবন্ধিতা দেখা দেয়।

জন্মের পরে বিভিন্ন কারণে প্রতিবন্ধিত্ব বরণ করে থাকলে তাকে অর্জিত প্রতিবন্ধিতা বলে। যেমন, ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে বেলজিয়ামে খনি-দুর্ঘটনায় অসংখ্য লোক মারা যায় এবং পাঁচ সহস্রাধিক আহত ব্যক্তি চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে নিক্ষেপ করা এটম বোমার আঘাত, ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের রাশিয়ায় চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লির বিষ্ফোরণ ও তেজস্ক্রিয়তা, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মারণাস্ত্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘঠিত অসংখ্য ছোট ছোটযুদ্ধ, নানাবিধ দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর বেশ কিছু রাষ্ট্র, সামাজিক সংস্থা তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের জন্য চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে আসে। সেই বোধ থেকেই প্রতিবন্ধীদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার দায়বদ্ধতার বিষয়টি মানুষের নজরে আসে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সুবিচার লাভের অধিকারী’। ২৮নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী, পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না’। উল্লিখিত ২টি অনুচ্ছেদ ছাড়াও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে আরো কিছু অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনযাপনকারী ব্যক্তির ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে। যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানে এবং আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র ও সিদ্ধান্তসমূহে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সম-অধিকার নিশ্চিতকরণের নীতিসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেহেতু বাংলাদেশ সরকার নিম্নোক্ত বিবৃতি ও ব্যবস্থাসমূহ যেমন- প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধকরণ, আগাম নিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষাদান, জনবল উন্নয়ন, গবেষণা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রতিবন্ধীদের দ্বারা স্ব-নির্ভর আন্দোলন, চিহ্নিতকরণ ও নিরোধ, সহায়ক উপকরণ প্রদান, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান, মুক্ত চলাচল ও যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধা, চিত্ত-বিনোদন, বাস্তবায়ন ও সমন্বয়সাধন ইত্যাদি সরকারের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

সংবিধানের ১৫, ১৭, ২০ এবং ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অন্যান্য নাগরিকদের সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমসুযোগ ও অধিকার প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ মোতাবেক দায়-দায়িত্বের অংশ হিসেবে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসেব মতে দেশে প্রায় ১৭ লাখ সাত হাজার প্রতিবন্ধী রয়েছে, যা মোট জনগোষ্ঠীর ১ দশমিক ০৩ শতাংশ। বর্তমানে প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মাসিক ৭৫০ টাকা হিসেবে ভাতাপ্রদান করা হয়। সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা বিতরণ করা হচ্ছে। কোন কোন ভাতাভোগীর টাকা তাঁদের ব্যাংক হিসাবে প্রেরণ করা হচ্ছে। অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য নীতিমালা যুগোপযোগীকরণ, সংসদ-সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তকরণ এবং ডাটাবেইজ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের জরিপে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে ১০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী বলে দাবি করা হয়। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম-অধিকার, সমমর্যাদা প্রদান, সম-অধিকার ও সুরক্ষা আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা সহযোগিতার জন্য সরকার ৬৪টি জেলায় একটি করে সমন্বিত স্কুল চালু করেছে। সেখানে প্রথম শ্রেণি হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেখানো হয়। প্রত্যেকটি জেলায় সরকার কর্তৃক নির্বাচিত মাধ্যমিক স্কুলের একটি কক্ষ বরাদ্দ নিয়ে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক এই শিক্ষাপদ্ধতি পরিচালনা করে থাকেন। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতায় জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রের অধীন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে ১ম-৫ম শ্রেণি পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা হয়। তাছাড়া গণিত শেখার জন্য এবাকাস ও ট্রেইলর ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ‘ওরিয়েন্টেশন,  মবিলিটি’ ও ‘এডিএল’ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে কোনো স্থানে নিরাপদে চলাচল ও দৈনন্দিন কার্যাবলীর ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী হবার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করানো হয়। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল সৃষ্টি, বিশেষ শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও বিতরণসহ সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তোলাই জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। এ কেন্দ্রে রয়েছে বিশেষ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, মানসিক, শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জন্য পৃথক স্কুলসহ হোস্টেল। শিশুকেন্দ্রিক পরিকল্পনা অনুসারে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা প্রদান করার জন্য ‘স্পেশাল স্কুল ফর অটিস্টিক চিলড্রেন’ নামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তথ্যপ্রযুক্তিতে ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। লক্ষণীয় যে, প্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের কর্মমুখী করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করায় প্রতিবন্ধীরা সাধারণ, সুস্থসবলদের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল প্রশিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের সেতুবন্ধন রচনার জন্য সেন্টার ফর সার্ভিসেস এন্ড ইনফরমেশন অন ডিজ্যাবিলিটি-র সহযোগিতায় বিসিসি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আইসিটি টাওয়ারে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্যোগে চাকুরি মেলা আয়োজন করে আসছে। প্রতি বছরই সারাদেশ থেকে চাকুরিপ্রার্থী হিসেবে শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, বাক ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধীরা মেলায় অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন ধরনের চাকরি পেয়ে আসছেন। সরকারি-বেসরকারি সকল স্থাপনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজ চলাচলের জন্য ঢালু পথ বা (Ramp) স্থাপন করার নির্দেশনা রয়েছে, যাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতায়াত সহজতর হয়।

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু রয়েছে। এইসকল কেন্দ্রের কার্যক্রম হচ্ছে বিনামূল্যে থেরাপি প্রদান, অটিজম সচেতনতা ও দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, অটিজম ও এনডিডি কর্নার সেবা, স্পেশাল স্কুল ফর অটিজম চিলড্রেন, জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র, কর্মজীবী প্রতিবন্ধী পুরুষ ও মহিলা হোস্টেল, ভ্রাম্যমাণ থেরাপি সার্ভিস,  ক্ষুদ্র ঋণ ও অনুদান কার্যক্রম, পিতৃ-মাতৃহীন প্রতিবন্ধী শিশু নিবাস, প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ, প্রতিবন্ধিতা উত্তরণ মেলা,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস এবং বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন, প্রকাশনা, গণসচেতনতা ও প্রামাণ্য চিত্র তৈরি ও প্রদর্শন, সেমিনার ও ওয়ার্কশপ, নীলবাতি প্রজ্বলন ইত্যাদি।এছাড়াও  প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে অকুপেশনাল থেরাপি, হিয়ারিং টেস্ট, ভিজুয়্যাল টেস্ট, কাউন্সেলিং ইত্যাদি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো ভ্রাম্যমাণ ওয়ান স্টপ থেরাপি সার্ভিস চালু করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ডরমেটরি, অডিটরিয়াম, ওপিডি, ফিজিওথেরাপি সেন্টার, শেল্টারহোম, ডে-কেয়ার সেন্টার, বিশেষ স্কুল ইত্যাদির সংস্থান রাখা হয়েছে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ফুটবল ও ক্রিকেট ফিল্ড, বিনোদন, সুইমিংপুল, জিমনেসিয়াম, মসজিদ, আবাসন, গেস্ট হাউজ, হোস্টেল ইত্যাদি সুবিধা সম্বলিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞগণের সমন্বয়ে নিয়মিত সেমিনার ও ওয়াকর্শপ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার সুবিধার জন্য স্থায়ীভাবে শিক্ষা-উপবৃত্তি চালু করেছেন। ১ম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত আগ্রহী শিক্ষার্থীগণ এই সুযোগ গ্রহণ করছেন। স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার-নির্ধারিত ফরমে জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর মাসে এই আবেদন করা যায়।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সেখানে শারীরিক, দৃষ্টি, বাক ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে বিভিন্ন মেয়াদি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানপূর্বক স্বাবলম্বী করে তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের নগদ ঋণ প্রদান করার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে হেয়ারিং মোল্ড, কৃত্রিম হাত-পাসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন সহায়ক উপকরণ প্রস্তুত করা হয়। এখানে তারা বাঁশ-বেতের কাজ, সাদাছড়ি প্রস্তুত, সঙ্গীতশিক্ষা, অরিয়েন্টেশন মবিলিটি, ব্রেইলপুস্তক মুদ্রণসহ বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্বনির্ভর হচ্ছে।

ঢাকার সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের বিশেষায়িত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং কয়েকটি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। যেমন- ফিজিও-থেরাপি, অকুপেশনাল-থেরাপি, প্যাথলোজিক্যাল, রেডিওলজি, ডায়াগনস্টিক সার্ভিস, বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম ইত্যাদি। তাছাড়া বিপিকেএস প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, ক্ষমতায়ন এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠিত করে স্ব-সংগঠন তৈরিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে, যার লক্ষ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগী করা। এই সংস্থাফিজিও-থেরাপি, অকুপেশনাল-থেরাপি, অরিয়েন্টেশন মবিলিটি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান কার্যক্রম, শিক্ষা-উপকরণ, রেফারেল সার্ভিস, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণসহ মাঠ পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা প্রদান করার লক্ষ্যে ‘থেরাপি প্রোভাইডার প্রশিক্ষণ’ প্রদান  করে থাকে। এই প্রশিক্ষণে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়াসহ সমুদয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা-উপকরণ সংস্থাটি বহন করে থাকে। অধিকন্তু নিন্মোক্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্নভাবে সেবা প্রদান করে থাকে। যেমন-
Bangladesh National Society for the Blinds (BNSB): এই সংস্থাটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চক্ষুপরীক্ষা ও অপারেশন, ঔষধ প্রদান, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট, অপটিক্যাল ও নন-অপটিক্যাল সেবা, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা-উপকরণ বিতরণ ও পুনর্বাসনসেবা প্রদান করে। Baptist Sangha School for Blind Girls (BSSB): এই সংস্থাটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারীদের বিনামূল্যে সকল ধরনের শিক্ষাসহায়তাসহ, চক্ষু পরীক্ষা ও এর পরিচর্যাসহ অপারেশন করে থাকে। Sight Saver International (SSI): এই সংস্থাটি সরকারি ও স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে চক্ষুরোগীদের সাধারণ চিকিৎসা, কম দৃষ্টি ও অতিমাত্রায় ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের চশমা ও চিকিৎসা দিয়ে থাকে। Vocational Training Center for the Blinds (VTCB): এই সংস্থাটি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্বাবলম্বী নাগরিকরূপে গড়ে তুলছে। সংস্থাটি, চক ও পেন্সিল তৈরি, তাঁত পরিচালনা, বই-খাতাপত্র বাঁধাই, কম্পিউটার পরিচালনা, পিএবিএক্স লাইন পরিচালনা, মোমবাতি তৈরি, দর্জিবিজ্ঞান প্রশিক্ষণ ও থেরাপিউটিক ম্যাসাজ-এর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। Jakir White Cane: এই সংস্থাটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সাদাছড়ি উৎপাদন ও তাঁদের শিক্ষা-উপকরণ তথা স্টাইলাস ফ্রেম, ট্রেইলর ফ্রেম, অ্যাবাকাস উৎপাদন ও বিপণন করে থাকে। Society for Education and Care of Hearing Impaired Children of Bangladesh (HICARE): এই প্রতিষ্ঠানটি শ্রবণ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শ্রবণমাত্রা নির্ণয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে যথাযোগ্য শ্রবণযন্ত্র প্রদান করে থাকে। শ্রবণ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা, প্রতিবন্ধী শিশুদের মুখে কথা বলা ও ভাষাশিক্ষা দিয়ে দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় যোগ্য করে গড়ে তোলে। Society for Assistance to Hearing Impaired Children (SAHIC): এই সংস্থাটি শ্রবণসমস্যা শনাক্ত করার মাধ্যমে শ্রবণ-প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ, হেয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট, শ্রবণশক্তি পুনরুদ্ধার, স্পিচ-থেরাপি, নাক-কান-গলায় সৃষ্ট সমস্যা চিকিৎসা ও শ্রবণযন্ত্র প্রদান করে থাকে। World Concern (WC): এই বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থাটি ২-১৫ বছর বয়সের মানুষ, যারা কানে না শুনার জন্য কথা বলতে পারে না তাঁদেরকে ভাষাশিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা দিয়ে স্কুলে ভর্তি করার উপযোগী করে তোলা ছাড়াও যে কোনো বয়সের লোক, যারা শ্রবণসমস্যাগ্রস্ত, তাঁদের শ্রবণসমস্যার কারণ ও মাত্রা নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে থাকে।

The Salvation Army Bangladesh: এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটিশ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের শ্রবণসমস্যা পরীক্ষা, মাত্রা নির্ণয় ও শ্রবণযন্ত্র প্রদানের মাধ্যমে শিশুদের কানে শোনার ও কথা বলার উন্নতি করে থাকে। তাদের স্কুলে বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশু ছাড়াও গরিব অসহায় শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা-উপকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও শ্রবণ সহযোগী সামগ্রী প্রদান করে থাকে। এই সংস্থাটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ, কাউন্সেলিং, স্পিচ-থেরাপি, ফিজিওথেরাপি ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ শিক্ষা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন করে থাকে। National Allaince of Disabled People’s Organization (NADPO): প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত এবং তাঁদের দ্বারা পরিচালিত ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মরত স্ব-সংগঠন সমূহের একটি  প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তাঁদের বাধামুক্ত চলাচল নিশ্চিত করা, সরকারি উচ্চ পর্যায়ে প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি উপস্থাপনা ও জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। এছাড়া জনপ্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের ব্যাপারে মত-বিনিময় করে থাকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা মো. হাসান বলেন, সরকার ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধীদের জন্য বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তবে লক্ষণীয় যে,  প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে জনসচেতনতা খুবই ধীরে গতিতে বাড়ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য গণপরিবহনে আসন বরাদ্দ থাকলেও সেখানে বসে থাকেন অন্যরা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সিটি কর্পোরেশন প্রতিবন্ধী সহায়ক ফুটপাত নির্মাণ করলেও তা দখল করে আছে অন্যান্য স্থাপনা, উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা চালু থাকায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং স্বল্প শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ভর্তি হয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেও চাকরির সুযোগ খুবই অপ্রতুল। স্বল্প শারীরিক জটিলতা থাকা কিছু ব্যক্তিকে বাণিজ্যিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নিয়োগ করলেও বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চাকরিহীন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে প্রতিবন্ধীরা নিজেদের মর্যাদা যেমন বাড়াতে পারবে তেমনি রাষ্ট্রের বোঝা না থেকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে।

লেখক : প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003978967666626