প্রথম থেকে অবহেলা করলেই সর্বনাশ - দৈনিকশিক্ষা

প্রথম থেকে অবহেলা করলেই সর্বনাশ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ছেলেটা মাত্র সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। শিশু শিক্ষার্থীটি এত অল্প বয়সেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে স্কুল পর্যন্ত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে শুধু সহপাঠীদের আপত্তিজনক/অপমানজনক আচরণের কারণে, যার নাম ‘বুলিং’। স্কুল থেকে শিশুটি ঝরে পড়ে এমন একটা বয়সে, যে বয়সে তার উচ্ছল হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর কথা। কী রকম বুলিং হয়েছিল শিক্ষার্থীটির ওপর? সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, সহপাঠীরা শিশুটির দেহের আকার আর ত্বক নিয়ে প্রত্যেক দিন কটুকাটব্য করত, যা তার মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। ফলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সবকিছু থেকে সে নিজকে গুটিয়ে নেয়। অভিভাবকরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানো সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, বরং উলটো অভিভাবকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে, শিশুটিকেই দোষারোপ করে এবং শিশুটিকে স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে। শিক্ষার্থীর বাবা ৮৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিশ দিয়েছে। আমরা পরিণাম দেখার অপেক্ষায় আছি। আরেকটি ঘটনা। মাত্র কয়েক দিন আগে বরিশালের একজন শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী তিনজনের কবলে পড়ে শার্ট খুলে নামতা পড়াসহ অশ্রাব্য গালিগালাজের শিকার হয়। এ দুটো ঘটনা বুলিং আর র্যাগিংয়ের দুটি অতি ক্ষুদ্র ঘটনা; আছে আরো অনেক ভয়ংকর বুলিং-র্যাগিংয়ের উদাহরণ এ দেশের শিক্ষাঙ্গনে। নাম যা-ই হোক না কেন (আসলে বুলিংও এক ধরনের র্যাগিং; মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ), এসব হচ্ছে নষ্ট মানুষের ভ্রষ্টামি। লেখাপড়া করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত শিক্ষার্থী অন্য নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর নানা অকল্পনীয় পন্থায় নির্যাতন চালায়। আর সব ঘটে শিক্ষক-প্রশাসকদের গোচরেই। কিন্তু তারা নির্বিকার প্রায় সর্বক্ষেত্রে। ধস নেমেছে শুধু ছাত্রসমাজের মধ্যেই নয়, শিক্ষকসমাজের মধ্যেও। যারা ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন, তারা ভালোই থাকতে চান এক কোনায় বসে থেকে। তারা নড়বেন না, চড়বেনও না। ভালো মানুষ সেজে আড়চোখে সব দেখে শুধু সমালোচনার ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বেদের মেয়ে জোছনার মতো ‘শান্তি নিবেন গো, শান্তি’ বলে বলে রাজপথ ঘুরে বেড়াবেন। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, অনেক কিছুতেই আমরা প্রথম দিকে তেমন মাথা ঘামাই না। ঘামানোর প্রয়োজনও মনে করি না। ঘাড়ে চেপে বসলেই মৃদু নড়াচড়া করতে শুরু করি। তত দিনে যা হবার হয়ে যায়। সর্বনাশের বারোটা বেজে যায়। তখন তেমন কিছু করার থাকে না। বড়ো ধরনের ঘটনা না ঘটলে অনেক বিষয় আড়ালেই থেকে যায়। আর সমাজের হাড্ডি-মজ্জা হয়ে যায় চূর্ণবিচূর্ণ। এমন নজির এ দেশে অজস্র। শুরু করি রগকাটা কাহিনি নিয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই যে আশির দশকে শুরু হলো বিরোধীদলীয় ছাত্রদের ধরে ধরে রগকাটার ঘৃণ্য কালচার, তা মহামারি রূপ নিয়েছিল পরবর্তী সময়ে। অনেক দেরিতে হলেও অন্য সরকার এসে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় সেটি পালিয়েছে। তবে তার স্থান দখল করেছে র্যাগিং আর বুলিং। যারা জানেন এবং যাদের কিছু করার ছিল তারা জেনেবুঝেও কোনো পদক্ষেপ নেননি। ফলে তা আজ আতঙ্কের এক মহিরুহ। এ নিয়ে পরে বলছি। ইদানীংকালের আরেক সামাজিক ব্যাধি অনেকটা চোখের অগোচরে বেড়ে উঠছে (অতি সাম্প্রতিক কালে বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়েছে), নাম তার ‘কিশোর গ্যাং’। অল্প বয়সি ছেলেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় সব শহরে। হঠাত্ কয়েক মাস ধরে দলবদ্ধ ধর্ষণ শহরে-গ্রামে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বাস-ট্রেন-টেম্পো-স্কুটারসহ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় লম্পট শিক্ষকদের লাম্পট্য কাঁপিয়ে দিচ্ছে সমাজের ভিতকে। আর কর্মস্থলে তো প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ কর্মজীবী নারী নির্যাতনের শিকার অনেক আগে থেকেই। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে-শহরে তালাকের হিড়িক। নারী নির্যাতনের পাশাপাশি শুরু হয়েছে পুরুষ নির্যাতন। শিশু নির্যাতন তো এখন নিত্য ঘটনা, ঘরে বাইরে সর্বত্র। এ কয়টা বিষয় শুধু উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলাম। এর বাইরেও আছে অনেক ঘটনা, যা সমাজে পচন ধরাচ্ছে; এখনই সামাল না দিলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন পচনধরা সমাজের গলিত স্রোত দেশের বুকে অজস্র নহর সৃষ্টি করে সব লন্ডভন্ড করে দেবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাস ধরে এ দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীসহ তাদের এ দেশীয় দোসররা, বিশেষ করে রাজাকার বাহিনী, শুরু করেছিল রগ কেটে বাঙালি মারা। স্বাধীনতার পরে চারটি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জাতির জনককে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেওয়া সামরিক শাসকদের ছত্রছায়ায় থেকে দেশবিরোধীরা পাকিস্তানিদের শেখানো রগকাটা প্রথা শুরু করে প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-হোস্টেলে। বিশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ছিয়ানব্বইতে এসে দেশ শাসন করার ক্ষমতা পাওয়ার পর স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির দলটির প্রচেষ্টায় হল-হোস্টেল থেকে রগকাটার কালচার দূর করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পালাবদলের পর শুরু হয় ক্যাম্পাসে হায়েনার উল্লাস, হলে-হোস্টেলে গেড়ে বসে র্যাগিং, বুলিং, গণরুম আর গেস্টরুম আতঙ্ক। কোথাও কোথাও পরিকল্পিত টর্চার সেল। কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তরুণদের অবিমৃশ্যকারিতা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিলে তিলে বড়ো হয়েছে তালগাছ। এখন বজ্রপাতও তালগাছকে নাড়াতে পারছে না। বিষবৃক্ষ হয়ে দেখা দিয়েছে এ অনাচারের কালচার। শুধু বিষ ঝরছে। এক ধরনের পিশাচের জন্ম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ছড়িয়ে পড়েছে অনেক কলেজেও। ‘অবলা’ মেয়েদের হল-হোস্টেলও বাদ যাচ্ছে না। সেখানেও পিশাচির তাণ্ডব। জন্ম নিচ্ছে কাগুজে মেধাবী, গড়ে উঠছে এক অমানবিক ‘শিক্ষিত গোষ্ঠী’। তাদের ঘরে কি জনম নেবে না আরো বহু দানব? দানবের ঘরে মানব জন্মের কোনো কারণই থাকতে পারে না। আস্তে আস্তে কি সমাজটাই দানবের কবলে চলে যাবে না? সাধুরা কবে হবে সাবধান? সাবধান হওয়ার বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? গণমাধ্যমে দেখলাম, কীভাবে কম্বল দিয়ে আবর্জনা ঢাকার চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। যে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট, তাকে ঢেকে রাখা যাবে কয় দিন? কেনই-বা ঢেকে রাখা? কার স্বার্থে? গন্ধ যখন ছড়াতে থাকবে, তখন তারাও কি রেহাই পাবেন? বিকট দুর্গন্ধ কি তাদের নাকমুখের পাশ গলিয়ে চলে যাবে? আত্মপ্রবঞ্চনায় ডুবে থাকলে কোনো লাভ হবে না। তাদেরকে অনুরোধ করছি, দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখুন :কীভাবে একদল স্বঘোষিত ‘বড়ো ভাই’ ‘ছোটো ভাই’দের ওপরে হলে-হোস্টেলে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছে, কত প্রকারে চালাচ্ছে এবং কত অমানবিক কায়দায় নির্যাতন করছে। ২০১৮ সালের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের উল্লেখ করে একটি দৈনিক পত্রিকা লিখেছে হলগুলোতে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ওপর সিনিয়র দানব-পিশাচদের নির্দয়, নিষ্ঠুর, অমানবিক অপকর্মের কায়দা-কৌশল : রড দিয়ে পেটানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেওয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া, গাছে ওঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, মুরগির মতো করে বসিয়ে রাখা, ব্যাং দৌড়ে বাধ্য করা, সিগারেট-গাজা-মদ্যপানে বাধ্য করা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করানো, সবার সম্মুখে নগ্ন করে নাচানো, যৌন অভিনয়ে বাধ্য করা, যৌন হয়রানি করা, ন্যাংটা করা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাপ নেওয়া, শীতের মধ্যে পানিতে নামিয়ে নির্যাতন করা, পুরোনো শিক্ষার্থীদের থুতু মাটিতে ফেলে নতুনদের তা চাটতে বলা, গালাগাল করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম কিংবা মাঠের মাপ নেওয়াসহ আরো অনেক জঘন্য পদ্ধতি। এত কিছু ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রভোস্ট, আবাসিক শিক্ষক, কলেজের অধ্যক্ষ আর হল সুপাররা কিছুই জানেন না, তা বিশ্বাস করতে বললেই বিশ্বাস করব? সবাই যেন গাছের আড়ালে লুকিয়ে ঝড় থামার অপেক্ষায় আছে। বুয়েটের নবীন ছাত্র আবরার হত্যার পর বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হওয়ার কারণে কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও কার্যকর পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত তেমন দেখা যাচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, হলে হলে তল্লাশি করে যে-ই অপরাধী হোক, তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য। দলবল, পদ-পরিচয় কিছুই তিনি দেখবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আমরা চাই, বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে শিক্ষাঙ্গন থেকে নির্মূল হোক এসব অনাচার। জ্ঞানচর্চার স্থান কেন হবে পিশাচ তৈরির কারখানা?

ড. এম এ মান্নান : কলামিস্ট; উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049519538879395