ঝিনাইদহের শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এক বছরে ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে প্রধান শিক্ষক দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহারসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠেছে আচমকা বিদ্যালয়ের বেতন এবং সেশনের দ্বিগুণ বৃদ্ধি নিয়েও। এছাড়া প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সহকারী প্রধান শিক্ষককে উপেক্ষা করে জুনিয়র শিক্ষকদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে চাকরিবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে প্রধান শিক্ষক দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দার দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে বলেন, ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক নয়। রেজুলেশান আর ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই স্কুল পরিচালনা হচ্ছে। একজন শিক্ষক তার বিরুদ্ধে ভুল করে অভিযোগ করেছেন।
এসব বিষয়ে শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. উসমান গনি জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি গঠন সহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি সব কিছু খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে একটি মিটিংও করেছেন।
এসব নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। অনিয়মের প্রতিবাদে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জনও করেছেন। এরপর বিদ্যালয়ের সেসব অনিয়মের লিখিত ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে শিক্ষা অফিসার, জেলা প্রশাসক, শিক্ষা বোর্ডসহ দুর্নীতি দমন কমিশনে। ম্যানেজিং কমিটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন তার স্বাক্ষর ছাড়ায় রেজুলেশন, চেকসহ সমস্ত তহবিল হিসাবে নানা জালিয়াতি করেছে প্রধান শিক্ষক। আর বিদ্যালয়টির বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত কমিটি গঠনসহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসের কথা জানিয়েছেন।
বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ফজলুর রহমানের লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, রেজুলেশন ও নোটশিটে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির স্বাক্ষর ছাড়াই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কমিটির অনুমোদন ছাড়া অর্থ ব্যয় আবার কখনো সাধারণ তহবিল ছাড়া বিদ্যালয়ের নামে কৌশলে নতুন একাউন্ট করে চেকে একক স্বাক্ষরেই চলছে টাকা উত্তোলন। কখনো বা বিল-ভাউচার জালিয়াতি, ফর্ম ফিলাপ-রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, নীতিমালার বাইরে হ্যান্ডক্যাশ উত্তোলন, নির্ধারিত নোটবই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা, বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা তুলে আত্মসাৎ, ৫০ শতাংশ হারে বেতন উত্তোলন এমন হাজারো অভিযোগ উঠেছে দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দার দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে বলেন,বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ফজলুর রহমান আমার বিরুদ্ধে ভুল করে অভিযোগ করেছেন। এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।
এ বিষয়ে ফজলুর রহমান বলেন, ‘প্রধা্ন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভুল করে করিনি। স্বেচ্ছায় এবং তথ্য প্রমাণসহ অভিযোগ করেছি যা তদন্তেই প্রমাণ হবে সত্য নাকি মিথ্যা।’
প্রধান শিক্ষক দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে জেএসসি,এসএসসি ও নবম-দশম শ্রেণির ফর্ম পূরনের ২০ হাজার, ১ লাখ ৩৭ হাজার, ১৮ হাজার ৪২০ ও ৮ হাজার ৮০০ টাকা জমা হয়নি। বিদ্যালয়ের নামে সোনালী ব্যাংকে(অ্যাকাউন্ট নং-২৪২১৬০১০২১২৯৯) নতুন অ্যাকাউন্টে প্রধান শিক্ষকের একক স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যাবে, সেখানে রাখা হয়েছে ৬৩ হাজার টাকা। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে পরীক্ষার খাতা-বই বিক্রি, জরিমানা আদায়, প্রাইভেট পড়ানো বাবদ শিক্ষকদের কাছ থেকে মোট ৮ হাজার ৮০০, ১৫ হাজার ৭৫০, ১৫ হাজার ৫০০ ও ২৬ হাজার টাকা জমা হয়নি। ড্রাম ক্রয় বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০ টাকা আদায় হলেও ভাউচারে আবারো ১৫ হাজার টাকা, বিদেশ সফরের পর ব্যক্তিগত আপ্যায়ন বাবদ ১০ হাজার টাকা খরচ দেখালেও ভাউচারের মাধ্যমে আবারো ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে জেএসসি ও এসএসসি ফিস বাবদ ২৭ হাজার ৮৫০, ৬ষ্ঠ শ্রেণি রেজি: বাবদ ১০ হাজার টাকা জমা দেয়া হয়নি। বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষক ১০০ পার্সেন্ট বেতন ভাতা পাওয়ার পরেও নন এমপিওদের মতো ৫০ শতাংশ হারে প্রতিমাসে ১৪ হাজার ৫০০ করে অবৈধ ভাবে ৫৮ হাজার টাকা ও প্রতিমাসে হ্যান্ডক্যাশে ৫ হাজার করে ৫৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রাইভেট বাবদ ১৫ হাজার, ভুয়া ভাউচারে সাউন্ড সিস্টেম বাবদ ৫ হাজার, এসএসসি বিজয়ীদের উপহার বাবদ ছাত্রীদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হলেও ভুয়া ভাউচারে আবারো ২১ হাজার ৭২৫, বেঞ্চ ক্রয় বাবদ ভুয়া ও কাটাকাটির ভাউচারে ১০ হাজার, এসএসসি উন্মুক্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১শ টাকা হারে চাদা ২৪হাজার ৫শ, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জরিমানা বাবদ ৬০ হাজার টাকা ও ছাত্রী ভর্তি বাবদ ৩ লাখ টাকার বেশি জমা করা হয়নি হিসাবের খাতায় । এসএসসির প্রশংসাপত্র বাবদ ২৫০ টাকা হারে ৪৩ হাজার ২৫০ টাকা আয় হলেও তা হিসাবে জমা করা হয়নি।
এভাবে প্রায় ১০ লাখ ২০ হাজার টাকার উপরে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগে বিস্তারিত বিবরণে জানানো হয়েছে। ফর্ম ফিলাপের জন্য বোর্ড নির্ধারিত ১,৫৭৫ টাকার বাইরে ১,৯৪০ টাকা হারে কখনো ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত করে আদায় করা হয়েছে বলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন প্রকাশনীর গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন প্রকাশনীর গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করার বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক দিলারা ইয়াসমনি জোয়ার্দার। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে বাধ্য করিনি। উল্টো তাদের গাইড বই কিনতে নিষেধ করেছি। লভ্যাংশের টাকা আত্নসাতের প্রশ্নই আসে না।
শৈলকুপা শহরে ফুটপাতে কলার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন আব্দুর রশিদ, তিনি জানান তার মেয়ের ফর্ম ফিলাপের জন্য ৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে প্রধান শিক্ষকের কাছে, জোর অনুরোধ করার পরেও তা শোনা হয়নি, তিনি আরো বলেন তার মেয়ে বিভিন্ন খেলাধুলায় ভাল ছিল, এসব দিকে তাকিয়েও কোন টাকা কম নেয়া বা বোর্ড নির্ধারিত টাকা নেয়া হয়নি। সাতগাছি গ্রামের নজরুল ইসলামের মেয়ে ডলি খাতুন জানান, ফর্ম ফিলাপের ১৮শ টাকার স্থলে কোচিংয়ের ১ হাজার টাকাসহ ৩৮০০ টাকা নেয়া হয়েছে, অথচ কোন ধরনের কোচিং করানো হয়নি। এ বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক দিলারা ইয়াসমনি জোয়ার্দার। তিনি বলেন, স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ফি আদায় করা হয়। বাড়তি কোনো টাকা নেয়া হয় না।
গত ১১ মাসে ৪ জন শিক্ষককে অন্যায় ভাবে শোকজ নোটিস দেয়া হয়েছে। এছাড়া তার অনুগত না থাকলেই তার বিরুদ্ধে শোকজের হুমকি দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তার মতের বাইরে কোন শিক্ষক-কর্মচারীকে মানবিক কারণেও ছুটি মঞ্জুর করেন না বলে জানানো হয়েছে। সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ কয়েক শিক্ষকের নিয়োগ ফাইল, মূল সনদ গায়েব করে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। এমন কি গত ১১ জুনে শৈলকুপা উপজেলার মাসিক আইন-শৃঙ্খলা মিটিংএ প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল প্রধান শিক্ষিকের অনিয়ম দুর্নীতির প্রসঙ্গ। এই মিটিং এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান শিকদার মোশাররফ হোসেন সোনাও ।
গত ১১ মাসে ৪ জন শিক্ষককে অন্যায় ভাবে শোকজ নোটিস দেয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দার। কেউ হয়তো ভুল করে এ অভিযোগ করেছে বলে তিনি দাবি করেন।