বই বিপণনের অভিজ্ঞতা এক যুগের বেশি হলেও প্রকাশনায় বাতিঘর একেবারে নবীন। বাতিঘর বই বিপণন শুরু করে ২০০৫ সালে। প্রথম বই প্রকাশ করি ২০০৯ সালে। আর প্রকাশক হিসেবে আমরা ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথম অংশগ্রহণ করি।
পাঠকের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমরা সীমিত অভিজ্ঞতা নিয়ে সব সময় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছি। বই বিপণন ও প্রকাশনা—দুই ক্ষেত্রেই আমরা ভেবেছি, পাঠক আসলে কী চান? পাঠকের এই চাওয়া এবং প্রকাশক-বিক্রেতার উপস্থাপনার মধ্যে কিছুটা ঘাটতি আছে বলে আমার ধারণা। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
বইয়ের জগতে নানামুখী সংকট থাকলেও প্রধান সংকট পাঠকের কাছে বই পৌঁছানো। অর্থ ব্যয় করেও অনেক সময় পাঠক প্রয়োজনীয় বইটি খুঁজে পান না। এ জন্য আমরা প্রথমে পাঠকের কাছে বই পৌঁছানোর কথা ভেবেছি। প্রকাশনা শুরু করেছি অনেক পরে। প্রথম পর্যায়ে বাতিঘর চট্টগ্রাম থেকে শুরু হলেও ২০১৮ সালে ঢাকায়, ২০১৯ সালে সিলেটে বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছি। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও বাতিঘরের কার্যক্রম সম্প্রসারণের স্বপ্ন আমাদের আছে।
একটি মননশীল জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সৃজনশীল বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বই প্রকাশনা আমাদের দেশে শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রকাশনা ব্যবসা মূলত বইমেলাকেন্দ্রিক। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। শুধু মেলার সময়ই বই প্রকাশ না করে অন্য সময়েও যাতে প্রকাশিত হতে পারে সে জন্য লেখকরাও প্রকাশকদের সহযোগিতা করতে পারেন।
আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় পাঠকসংখ্যা কম। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রচুর। অথচ বইয়ের ক্রেতা খুবই কম। ফলে বই প্রকাশনা শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। বই প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে পাঠক, লেখক, প্রকাশক, গণমাধ্যম, সর্বোপরি সরকারকেও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বই পড়ার সংস্কৃতিকে যুক্ত করতে হবে।
পাঠবিমুখতার ফলে আমাদের সমাজে নানা ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেসব সংকট আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরীক্ষায় পাসনির্ভর পড়াশোনার চাপে শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য খুদে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য খেলাধুলা করার পর্যাপ্ত সুযোগ যেমন করে দিতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পাঠ্য বইয়ের বোঝা কমিয়ে সৃজনশীল বই পাঠে উৎসাহী করে তুলতে হবে।
আমাদের দেশে পাঠাগার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যেসব পাঠাগার এখনো টিকে আছে, সেগুলোও প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে পড়ছে। একটা পাঠাগার একটা এলাকার বিভিন্ন বয়সী মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলে। প্রয়োজনীয় পাঠাগার গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। বইয়ের পরিবেশক না থাকায় ছোট প্রকাশকদের টিকে থাকা খুবই চ্যালেঞ্জিং। পেশাদারির অভাবে বেশির ভাগ প্রকাশনা সংস্থাকে বইমেলার পর খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্বের সর্বত্র প্রকাশক ও বিক্রেতার সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন পরিবেশকরা। বই প্রকাশক ছাড়া আর কোনো উৎপাদকই নিজেদের পণ্য এভাবে বিক্রি করেন না। যে কারণে মৌসুমি ব্যবসার মতো বইমেলা এলে বই প্রকাশের তোড়জোড় শুরু হয়।
আশার কথা, কয়েক বছর ধরে পাঠকরা বছরজুড়ে বিচিত্র ধরনের বইয়ের সন্ধান করছেন। সংখ্যায় সীমিত হলেও বেশ কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বইমেলা ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও বই প্রকাশ করছেন।
সৃজনশীল বই ব্যবসার জগতে গত এক দশকের মধ্যে অনেক নতুন ও তরুণ প্রকাশকের আগমন ঘটেছে। তাঁদের মাধ্যমে বই প্রকাশনায় অনেক বৈচিত্র্যও এসেছে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে, তাঁরাই বেশির ভাগ ভালো বইয়ের প্রকাশক। একইভাবে বই বিক্রি ও বিপণনে অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে।
বাতিঘরকে আমরা শুধু বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান বানাতে চাই না। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশে একটা পাঠকসমাজ গড়ে তোলা। পাঠক, লেখক, প্রকাশক সবাইকে নিয়েই এই কাজটি আমাদের করতে হবে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বইজগৎ পাল্টে যাবে বলে আশা করি।
লেখক :দীপঙ্কর দাশ, প্রকাশক, বাতিঘর