ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী নিয়োগ দেয়া হয় না। বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক রয়েছেন হাতেগোণা কয়েকজন। যথাযথ বিধান মেনে সর্বশেষ কবে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেন না। অমুক প্রভাবশালী আমলার স্ত্রী, শ্যালক-শ্যালিকা, ছোটভাই তমুক রাজনীতিকের ভাবী, অমুক মন্ত্রীর স্কুলের সহপাঠী এই হলো শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি। এসব স্বজনদের নিয়োগ দিতে প্রশ্নফাঁস, উত্তর ফাঁস, খাতা জালিয়াতি, ভাইবাবোর্ডে স্বজনপ্রীতি, কোনও পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠিয়ে দেয়ার চর্চা চলছে প্রায় দুইদশক ধরে। এছড়া সরাসরি মোটা অংকের ঘুষ দিয়েও চাকরি মেলে। এ করুণ চিত্র ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের।
গত কয়েকবছরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের বিবাদের সুযোগে ঢাকার জেলা প্রশাসক, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের আমলারা কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীদের পিএস, এপিএস, স্থানীয় সাংসদদের পিএসরাও নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে আসছেন এ প্রতিষ্ঠানটিতে। বর্তমানে একটি নির্বাচিত কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় দুজন কাউন্সিলরও রয়েছেন।
পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল ফিরোজ খান নূনের স্ত্রীর নামে স্কুলটি শুরু হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে কলেজ চালু হয়। বর্তমানে রাজধানীর নিউ বেইলি রোডের মূল প্রতিষ্ঠান ও তিনটি শাখায় মোট শিক্ষক সংখ্যা ৬৫০। ছাত্রী পঁচিশ হাজারের বেশি। যেনতেনভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের দাপটে প্রকৃত শিক্ষকরা কোণঠাসা। প্রভাবশালীদের স্বজনরাই শিক্ষকতার সাইনবোর্ড লাগিয়ে কোচিংসহ বিভিন্ন বাণিজ্যে নেমে পড়েন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র শিক্ষক দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ৭০ ভাগ শিক্ষকই প্রভাবশালীদের স্বজন। এদের বিরুদ্ধেই ছাত্রী ও অভিভাবকদের যত অভিযোগ। এরা শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নয়, নিছক চাকরি বা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্কুলকেন্দ্রিক শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য রয়েছে। স্কুলড্রেস, খাতা-কলম, খাবার সাপ্লাই, শিক্ষাসফর, এসএমএস সার্ভিসসহ কয়েক ডজন খাত রয়েছে ব্যবসার। এসবের আকর্ষণেই প্রভাবশালীরা ভিকারুন নিসার সঙ্গে যুক্ত হতে চান যেকোনও পরিচয়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন অধ্যক্ষ বলেন, বসুন্ধরা শাখায় ‘ম’ অদ্যাক্ষরের একজন শিক্ষক ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছে, যা সবার মুখে মুখে। কয়েকডজন যোগ্য শিক্ষক বছরের পর বছর খণ্ডকালীন হিসেবে চাকরি করলেও তাদের নিয়মিত না করে পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছেন স্থানীয় একজন আলোচিত সাংসদ। ওই সাংসদের স্ত্রী ও কথিত ভাতিজার দেয়া তালিকা অনুযায়ী কয়েকডজন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে বাছবিচারহীনভাবে।
তিনি বলেন, আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে একজনকে অধ্যক্ষ বানানো হয় কয়েকবছর আগে। তার শিক্ষাজীবনে দুটি তৃতীয় বিভাগ। নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। কয়েকবছর আগে একজন অধ্যক্ষ অবসরে গেছেন যার নিয়োগের নেপথ্যে ছিলেন একজন সাবেক মন্ত্রী।
বিগত বিএনপি-জামাত আমলে বিএম বাকির হোসেন নামের একজন ব্যাংকের সিবিএ নেতা কোটি কোটি টাকা খরচ করে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেন।
মজিবুর রহমান নামের বর্তমান কমিটির একজন সদস্যের স্ত্রীর শিক্ষাজীবনে একাধিক তৃতীয় বিভাগ হলেও তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সম্প্রতি। মজিবুর জামাতপন্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি ভোটে নির্বাচিত হন।
কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদারের কেউ পড়েন না ভিকারুন নিসায় তবুও তিনি কীভাবে সভাপতি হলেন? এ প্রশ্ন অনেকের মনে। তিনি মতিঝিল আইডিয়ালের গভর্নিংবডির দাতা সদস্য।
বেশ কয়েকজন শিক্ষক সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিবদের আত্মীয়স্বজন হওয়ায় মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষাবোর্ডে তাদের অপকর্ম নিয়ে অভিযোগ করলেও কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়না বলে অভিভাবকরা বলেছেন। প্রভাবশালীদের স্ত্রী ও স্বজনদের বিরুদ্ধে অভিভাবকরা অভিযোগ করেও ফল পান না। পরিমল জয়ধরের বিরুদ্ধে প্রথমে কেউ অভিযোগ করতেই সাহস পাননি। পরে অভিযোগ করলেও শাখা প্রধান ওই বিষয়টি প্রধান শাখার অধ্যক্ষ জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে অভিযোগ ও উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিদায় নেয় পরিমল। গ্রেফতারও হন।