সারা দেশে আজ (২ ফেব্রুয়ারি) থেকে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলে 'প্রশ্নফাঁস' নিয়ে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলি। বলি নানান কথা। প্রশ্নফাঁস বন্ধের পথ খুঁজি। পরীক্ষা শেষ হলে সারা বছর এ নিয়ে আর কারো মাথা ব্যথা নেই। আমাদের স্বভাব এমন যে, কোনো কিছুর সময় না এলে তা নিয়ে আগ্রহ অনুভব করি না। মাথা ঘামাইনা। সময় কাছে এলেই তৎপর হই। কিছু বিষয়ে আগে ভাগে চিন্তা না করলে উপস্থিত সময়ে কিছু করলেও তার ফল পাওয়া কঠিন। কেবল আলোচনা ও সমালোচনায় সমাধান মেলেনা। প্রয়োজন পরিকল্পনা। পরিকল্পনা যথারীতি বাস্তবায়ন করতে হয়। তারপরই সুফল মেলে। পরীক্ষাও তেমন একটি বিষয়।
এক সময় পরীক্ষায় নকলের দুর্নাম ছিলো। এখন সে বদনাম তেমন একটা নেই। সে সময় কোনো কোনো পরীক্ষা কেন্দ্র নকলে সয়লাব হয়ে যেতো। এমন অনেক পরীক্ষা কেন্দ্রের কথা জানি যেখানে পরীক্ষা শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বস্তা ভর্তি নকল কুড়িয়ে তা পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতেন। অভিনব পদ্ধতিতে কিছু শিক্ষার্থী নকল নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতো। বাইরে থেকেও কৌশল করে নকল সরবরাহ করা হতো। বাঁশের লম্বা খুঁটির মাথায় সুতো দিয়ে নকল বেঁধে পরীক্ষা হলের পেছন দিক থেকে দুতলা-তিন তলার উপর নকল সরবরাহ করা হতো। পরীক্ষার্থীর অভিভাবক কিংবা অন্য কেউ কাজটি করে দিতো। এক সময় কোনো কোনো পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে একজন পরীক্ষার্থীর একাধিক সাহায্যকারী দেখা যেতো। ডেস্ক ও বেঞ্চে আগে থেকেই অনেকে উত্তর লিখে ফেলতো। এমনও শুনেছি কলেজ পর্যায়ে কোথাও কোথাও অনেকে আগের রাতে ডেস্ক ও বেঞ্চে সম্ভাব্য উত্তর লিখে রেখে আসতো। কোনো কোনো কলেজে ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষার আগের রাত কেউ কেউ রিক্সা কিংবা ঠেলাগাড়ি দিয়ে ডেস্ক-বেঞ্চ বাসায় নিয়ে গিয়ে নাকি উত্তর লিখে এনে আবার রাতের মধ্যেই যথাস্থানে রেখে দিতো। কলেজের অসাধু কর্মচারী ও নাইট গার্ডরা সামান্য কিছু টাকা পয়সা নিয়ে সহায়তা করতো এসব অনৈতিক কাজে। অনেকে পরীক্ষার হলে বইয়ের পাতা ছিড়ে নিয়ে যেতো। ছোট ছোট করে লিখে টুকরো কাগজে নকল লেখা হতো। নকল ভাঁজ করে লুকিয়ে নেবারও ছিলো নানা স্টাইল। কী করে বেশি উত্তর কম কাগজে লিখে নেয়া যায় কিংবা কী করে বেশী কাগজ ভাঁজ করে করে খুব ছোট করে রাখা যায় সে কৌশল জানা থাকলে নকল করা সহজ হতো। কেউ কেউ এসব কাজে খুবই পারদর্শী ছিলো। নানা কৌশলে নকল নিয়ে পরীক্ষার হলে যেতো তারা। অনেকে পুরো নোট বই নিয়েই পরীক্ষার হলে ঢুকতো। নোট গাইড কম্পিউটার কম্পোজ করে খুব ছোট করে শার্ট কিংবা প্যান্টের যে কোনো একটা ফাঁকে ঢুকিয়ে রাখতো। কেউ কেউ হাতের তলায়, পায়ের তলায় এবং শার্ট কিংবা জামার উল্টো দিকে খুব ছোট করে নকল লিখে নিয়ে যেতো। নকলকারীরা কতো রকম কলা কৌশল অবলম্বন করতো তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিলোনা।
একবার এক পরীক্ষার্থীর কাছে হল পর্যবেক্ষক নকল ধরতে গিয়ে নকলের একটি সুচিপত্র পান। সুচিটি এরকম-'ডান পায়ের মোজার ভেতর রচনামুলক প্রশ্নোত্তর, বাম পায়ের মোজায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর, পেছনের পকেটে ব্যাখ্যা, ডান পকেটে টীকা, ডান পায়ের জুতার মধ্যে অমুক প্রশ্নের উত্তর, বাম পায়ের জুতার ভেতর তমুক প্রশ্নের উত্তর' ইত্যাদি নকল সংক্রান্ত নানা খতিয়ান। পরীক্ষা আরম্ভ হবার পর সুচিটি হস্তগত হওয়ায় নকল খুঁজে বের করতে কোনো কষ্ট পেতে হয়নি পর্যবেক্ষকের। যাক সে কথা। ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে নকলের ছড়াছড়ি সবচেয়ে বেশী ছিলো। নকল করার কারণে বহু শিক্ষার্থী বহিষ্কার হতো। কেউ এক বছর আবার কেউ দু' বছরের জন্য বহিষ্কার। তারপরও নকল থেমে থাকেনি।
এভাবে বছরের পর বছর নকলের দুর্নাম আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হবার পর আমরা এ দুর্নাম থেকে অনেকটা পরিত্রাণ পেয়েছি। এখন আর নেই নকলের ছড়াছড়ি। পরীক্ষার হলে নকল নিয়ে যাবার চেষ্টা কেউ করেনা। সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক এবং প্রশ্ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার করে নকল এক রকম প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এখন অন্য দুর্ণাম আমাদের। সেটি প্রশ্নফাঁসের দুর্নাম। এ ক্ষেত্রে মনে হয় আমরা অনেক দুর এগিয়ে গেছি। আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে প্রশ্নফাঁসের কথা কদাচিৎ শুনেছি। তবে, কয়েক বছর ধরে প্রশ্নফাঁস নিত্য নৈমিত্তিক এক মামুলি বিষয় হয়ে উঠেছে। নকলের দুর্নাম মুছে যেতে না যেতেই প্রশ্নফাঁসের বদনাম সারা দুনিয়ার কাছে আমাদের মাথা নত করে দিয়েছে। তাই নকলের মতো প্রশ্নফাঁসের বদনাম থেকে বাঁচার পথ আমাদের সবাইকে একসাথে খুঁজতে হবে।
প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে না পারলে লেখাপড়ার কী দরকার? পরীক্ষার কী প্রয়োজন? কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ছাপিয়ে পরীক্ষার আয়োজন করে কোনো লাভ নেই। সারা বছর স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করিয়ে কী হবে? যেনতেন ভাবে খাতা মুল্যায়ন করা হলেও পরীক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তাই এসব বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে ব্যবস্থা নেবার এখন উপযুক্ত সময়।
পুরনো সরকার নতুন করে ক্ষমতাসীন। নতুন শিক্ষামন্ত্রী। সাবেক মন্ত্রী মহোদয় প্রশ্নফাঁস নিয়ে বিগত দশ বছরে বহুবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। সরকারকেও কম বিব্রত হতে হয়নি। নতুন শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। আগের মন্ত্রী মহোদয়ও বিষয়টিকে কম চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেননি। কিন্তু খুব একটা বন্ধ করা যায়নি প্রশ্নফাঁস। চেষ্টা যে কম হয়েছে সে কথা বলছিনা। আরো চেষ্টার প্রয়োজন ছিলো। কেবল শিক্ষামন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিলে হবেনা। গোটা জাতিকে সম্মিলিতভাবে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। শিক্ষা না বাঁচলে জাতির মরণ ছাড়া আর কোনো গতি অবশিষ্ট থাকেনা। আশা করি নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় প্রশ্নফাঁস রোধে সফলতা অর্জন করতে পারবেন।
প্রশ্নফাঁস কারা করে? কেন করে? এ নিয়ে নানা জনের নানা কথা। কেউ কেউ বলেন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত থাকেন। শিক্ষকরা কি কারণে প্রশ্নফাঁসে জড়িত হবেন? শিক্ষার্থীরাই বা কেন এর সাথে জড়িত হবে? আমি তার কোনো জবাব খুঁজে পাইনা। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা করিয়ে পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত করেন। শিক্ষার্থীরাও সারা বছর পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করার জন্য প্রস্তুত হয়। তারা কেউই প্রশ্নফাঁসের প্রত্যাশা করেননা। তারপরও যখন প্রশ্নফাঁস হয়, তখন সে দায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপর বর্তায়। অনেকটা 'সব দোষ নন্দ ঘোষ'-এর মতো। পরীক্ষা দেয় শিক্ষার্থী আর পরীক্ষা নেন শিক্ষক। তাই এদের উপর প্রশ্নফাঁসের দায় চাপানো সবচেয়ে সহজ কাজ। যারা প্রশ্নফাঁস করে বা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত তারা, কাজটি করে নিজেরা পার পাবার চেষ্টা করে।
আমার সব সময় মনে হয় যারা নোট গাইড, কোচিং বাণিজ্য আর শিক্ষা বাণিজ্যের সাথে জড়িত তারাই প্রশ্নফাঁসের মূলহোতা। শিক্ষাকে যারা পণ্য বানিয়ে বাণিজ্য করে, তাদের কাছে প্রশ্নফাঁসের মতো জঘন্য অনৈতিক কাজ করা সামান্য একটি বিষয়। এটি তাদের কাছে কোনো ব্যাপার না। নিঃসন্দেহে এদের একটি সিন্ডিকেট আছে। সিন্ডিকেটটি চিহ্নিত করতে পারলে প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব। বিগত কয়েক বছর প্রশ্নফাঁস বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি সমূহের রিপোর্টে নিশ্চয় প্রশ্নফাঁস চক্রের বিষয়ে কোনো না কোনো ইঙ্গিত আছে। সে দিকেও দৃষ্টিপাত করলে এদের চিহ্নিত করা সহজ হবে। যারা নোট-গাইড আর কোচিং বাণিজ্য করে তারা শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দিতে যে কোনো অনৈতিক কাজ করতে দ্বিধা করেনা। নোট গাইড আর কোচিং বাণিজ্যের মতো এতো লাভ মনে হয় আর কোনো ব্যবসায় নেই। যারা শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করে, এমন কোনো কাজ নেই যেটি তারা করতে পারেনা। নোট গাইড ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য কতো ঢাকডোল পেঠানো হয়। তবু তা বন্ধ করা যায়না। এতো খুঁটির জোর তারা কোথায় ও কার কাছে পায় সেটি এখন বড় প্রশ্ন। পরীক্ষার সময়ে সরকার এক মাসের জন্য কোচিং সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। তার মানে বাকি এগারো মাস কোচিং সেন্টার খোলা থাকবে। কোচিং ব্যবসায়ীরা তাহলে অনায়াসে এগারো মাস বাণিজ্য চালানোর লাইসেন্স পেয়ে গেলো। পরীক্ষার সময়টাতে কোচিং সেন্টার এমনিতেই বন্ধ থাকে। চিরতরে কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে না পারলে প্রশ্নফাঁস মনে হয় কোনোদিন বন্ধ হবেনা। তাই চিরতরে কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়া একান্ত অপরিহার্য। পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে অন্ততঃ পরীক্ষার সময়ের জন্য এক দেড় মাস গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখলে মনে হয় সুফল পাওয়া যেতে পারে। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পরীক্ষার সাথে জড়িত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নজরদারিরও আওতায় আনা দরকার।
আরেকটি কথা-আমাদের সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক অধিকতর সংস্কার করা প্রয়োজন। প্রশ্ন এবং পরীক্ষা পদ্ধতিরও পরিবর্তন-পরিমার্জন একান্ত আবশ্যক। প্রশ্নফাঁস একদম বন্ধ করতে চাইলে সাধারণ ও গতানুগতিক শিক্ষার পরিবর্তে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। আর তত্বীয় পরীক্ষার চেয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। নকলের অভিশাপ আমরা মুছে ফেলতে পেরেছি। প্রশ্নফাঁসের কলঙ্ক আমরা ঘুচাতে পারবোনা কেনো? যে কোনো মূল্যে আমাদের সেটি করতেই হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এবারই প্রশ্নফাঁসের সমাধি রচিত হোক-আজকের দিনে তা হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।