প্রশ্নের সংস্কৃতি বিকশিত হোক - Dainikshiksha

প্রশ্নের সংস্কৃতি বিকশিত হোক

কাজী মসিউর রহমান |

আপেল কেন নিচের দিকে পড়ে? সপ্তদশ শতকের একটি 'শিশুতোষ' প্রশ্ন এটি। একবার ভেবে দেখুন, প্রশ্নটি কী সাধারণ আর সরল! কিন্তু এই সহজ শিশুসুলভ প্রশ্নের উত্তরে স্যার আইজাক নিউটনের চিন্তারেখা বেয়ে যা বেরিয়ে এলো তার বৈপ্লবিক প্রভাব বিস্মিত ও আপ্লুত করল মানব সভ্যতাকে। প্রশ্ন করা যায়, আপেল বা ভারী বস্তু কী শুধু নিউটনের সময় থেকে নিচের দিকে পড়তে শুরু করল? নাকি অনন্ত কাল ধরে পড়ে আসছিল? পূর্বে কেউ এতটা গভীর অভিনিবেশ নিয়ে এ প্রশ্নটি করেনি কেন? কারণ, অন্য সবাই এ বিষয়কে খুবই স্বাভাবিক ও আটপৌরে পৃথিবীর একটি নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তাই আমরা মধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম মাত্র সাড়ে ৩শ' বছর আগে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই মধ্যাকর্ষণ বলের আবিষ্কার আজকের বিকশিত বিজ্ঞানের অন্যতম সূত্র বিন্দু হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। 

একটি সার্থক প্রশ্নের ফলাফল আলোচনা করতে গিয়ে আপেল পতন সম্পর্কিত জিজ্ঞাসাটি উদাহরণ হিসেবে হাজির করা যায়। একই সঙ্গে প্রশ্নের ভেতর লুকিয়ে থাকা অনন্ত সম্ভাবনার ব্যাপারকেও তুলে ধরা যায়। শিক্ষা-দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন- একটি ভালো উত্তরের চেয়ে একটি উৎকৃষ্ট প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ২০০ মিলিয়ন কপি বিক্রীত উপন্যাস 'দি আল কেমিস্ট'-এর লেখক পাওলো কোয়েলহো বলেন, 'আমি একটি ভালো প্রশ্ন খুঁজে ফিরি; উত্তর নয়।' কারণ চিন্তাশীল প্রশ্ন মানুষকে সৃষ্টিশীল করে তোলে। চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করে। সে শিক্ষার্থীর হাতে হাত ধরে এগিয়ে যায় নতুন জ্ঞানের দিকে। প্রশ্ন এমন সব উত্তরের জগতে প্রশ্নকারীকে ঠেলে দেয় যা রীতিমতো বিস্ময়কর। একটি ভালো প্রশ্ন যে উত্তর আহ্বান করে, সেটি আবার কোনো না কোনো নতুন প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়। এভাবেই প্রশ্ন আর উত্তরের খেলা চলে নিরন্তর।

প্রশ্নকাতর হতে গেলে যে গুণটি মানুষের মধ্যে থাকতে হয়, তা হলো বিস্মিত ও মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা। এই বিজ্ঞাপন প্ররোচিত ভোগবাদী দুনিয়ায় আমরা আর মুগ্ধ হই না। বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে চোখের কোণে জমে না চিকচিকে এক ফোঁটা জল। প্রায় সবকিছু যেন জেনে গেছি বা মেনে নিয়েছি- এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় সর্বত্র এখন লক্ষ্য করা যায়। ওদিকে, শিশুদের রয়েছে বিস্মিত আর মুগ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে নির্মল আনন্দ পাওয়ার সারল্য। তারা এখনও এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি তেমন। পৃথিবীর ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে মানুষ নতুন কিছু জানার বা নিত্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করার সুযোগ হারিয়ে ফেলে। ফলে বঞ্চিত হয় জীবনের বৈচিত্রময় অনুষঙ্গ তলিয়ে দেখবার। একজন সাধক বা দার্শনিক তাই কখনোই পৃথিবীর ব্যাপারে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন না। সারাক্ষণ তার কাছে এ জীবন কিছুটা অপরিচিত ও হেয়ালি ভরা মনে হয়। এই জায়গায় সারল্যমাখা শিশু আর দার্শনিকদের ভেতর অদ্ভুত মিল বন্ধন রচিত হয়। 

সাধারণত আমরা দেখতে পাই, বিস্ময় কাতর শিশুরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে যখন বেড়ে উঠতে থাকে, তখন প্রশ্ন করার ক্ষমতাও ক্রমাগত হারিয়ে ফেলতে থাকে। কারণ, আমাদের পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্রে উত্তর প্রস্তুত করানোর যত আয়োজন; প্রশ্ন মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে ততটাই কঠোরতা, নিস্পৃহতা। প্রশ্ন কিন্তু অজ্ঞানতাকেই আঘাত করে সবচেয়ে বেশি। অন্যায় ক্ষমতাকেও সে চ্যালেঞ্জ করে। ক্ষমতা বিচলিত হয়। দুর্নীতিবাজরা ভীত হয়, আক্রান্তও হয়। এ কারণেই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নকে নিরুৎসাহিত করেছিল। ১৯৪৭-এ সরাসরি উপনিবেশ বিতাড়িত হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও উপনিবেশজাত মানসিকতা উপনিবেশিতের মনোজগতে নিবিড়ভাবে রয়ে গেল। একই সঙ্গে মস্তিস্কের আড়ালে টিকে থাকল পুঁজিবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ। তাই শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, পুরোহিত বা পিতা কাউকেই আর খুব একটা প্রশ্ন করা যায় না। জবাবদিহি রয়ে গেল শুধু কাগজ-কলমে বা আনুষ্ঠানিকতায়। 

আসলে প্রশ্নকে প্রশ্ন হয়ে উঠতে হয়। প্রশ্নবোধক ইঙ্গিতময় যে কোনো বাক্যই প্রশ্ন হয়ে ওঠে না। অর্থবহ কোনো প্রশ্ন ব্যক্তিকে আলোড়িত ও বিস্মিত করার সামর্থ্য রাখে। ভালো একটি প্রশ্নের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় গহীনতার টানে জ্ঞানসাধক বেপরোয়া ছুটে চলেন আরও গভীরে। অনুসন্ধানী একটি প্রশ্ন যেন প্রবল বাতাসে দীর্ঘকায় পাল তুলে ছুটে চলা কোনো এক ছিপছিপে তরণি, যা প্রশ্নকারীকে নতুন নতুন দ্বীপে নোঙর করার অনির্বচনীয় আনন্দ দেয়। মনে রাখা চাই, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি করতে পারার শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে গভীর সংশয় সৃষ্টি করতে পারা। সন্দেহ নয় অবশ্যই। কোনো বিষয়ে সুনিশ্চিত হয়ে গেলে সেখানেই রুদ্ধ হয়ে যায় প্রজ্ঞা অর্জনের সমূহ পথ। তাই ফরাসি দার্শনিক ভলটেয়ার মনে করেন- Doubt is not a pleasant condition, but certainty is absurd. 

একটি উন্নত প্রশ্ন সুন্দর সুগঠিত উত্তর খুঁজে পেতে অনুপ্রেরণা দেয়। এটা পাঠককে তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করার জন্যও আহ্বান জানায়। ইতোমধ্যে ব্যক্তি কী জানে, কতটা জানে বা কীভাবে সেটি জানে, তার মুখোমুখি দাঁড় করায় একটি উৎকৃষ্ট প্রশ্ন। একজন ভালো শিক্ষক যেমন জীবন জাগানিয়া, তেমনি একটি সুন্দর প্রশ্ন চেতনা জাগানিয়া। চিন্তনের অনুশীলনের প্রতি রয়েছে তার নিবিড় অঙ্গীকার। 

আবার সব প্রশ্নের অর্থবহ উত্তর থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সহজ-সরল উত্তরপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সাধকের আগ্রহের আগুনে ঢালে ফেনফেনে কাদা-জল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের মাত্র ১১ দিন আগে লেখা 'প্রথম দিনের সূর্য' কবিতায়ও লক্ষ্য করা যায় আজীবন খুঁজে ফেরা প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ার এক বিরহী বয়ান। 

'প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে-

কে তুমি?

মেলেনি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল।

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল

পশ্চিম সাগর তীরে 

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-

কে তুমি?

পেল না উত্তর-' 

চিন্তা উসকে দেয়া প্রশ্ন যেমন অনেক সময় সুনির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে পায় না, অন্যদিকে সেটি কখনও নতুন প্রশ্ন, কখনও মানুষের মাঝে তীব্র তর্ক সূচনা করার প্ররোচনা দেয়। চিন্তার মুক্তির জন্য এবং সত্যের খাতিরে নির্মোহ তর্ক অত্যন্ত মূল্যবান। মহান দার্শনিক সক্রেটিস নিজের জীবনের দামে তর্কের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়; তিনি তর্কের পদ্ধতিও দেখিয়েছেন। নোবেল বিজয়ী তাত্ত্বিক অমর্ত্য সেনও তর্কের গুরুত্ব দেখিয়েছেন তার 'তর্কপ্রিয় ভারতীয়' বইতে। আসলে যে সমাজে তর্ক ও সুস্থ আড্ডা নিরুৎসাহিত, সে সমাজ পশ্চাৎগামী ও রুগ্‌ণ। প্রতিক্রিয়াশীলতার অভয়াশ্রম। সমাজ-নেতাদের মৌলিক দায়িত্বের একটি হলো, গণতান্ত্রিক তর্কের জন্য জনপরিসর (Public sphere) সৃষ্টি করা। ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো শুধু অভিজাত ক্লাব তৈরি করলে সমাজের গভীরে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, নান্দনিকতা, মানবিক চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মননশীলতা বুনে দেওয়া সম্ভব হবে না।

ভয়ের চাদরে মোড়ানো এই সংস্কৃতির মধ্যে বসে কাকে প্রশ্ন করা যাবে আর কাকে যাবে না, সেই বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রশ্নের ক্ষমতা অপরিসীম। এর ভেতরে আছে প্রজ্বলিত আগুন। তাই বুদ্ধি ও সৃষ্টিশীলতা খাটিয়ে প্রশ্ন ছুড়তে হবে লক্ষ্যের দিকে। মূর্তকে যেমন প্রশ্ন করতে হবে, তেমনি বিমূর্তকেও। শ্রেণিকক্ষ থেকে গহন অরণ্য সব জায়গায় প্রশ্নরা প্রতিধ্বনিত হোক। প্রকাশ করার মতো সুযোগ না এলে নিজেকেই প্রশ্নের লক্ষ্য বস্তু বানানো যাক। তার পরও প্রখর প্রশ্নেরা বেঁচে থাক। আলজেরিয় বিপ্লবী দার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফানোর উক্তি দিয়ে এখানে লেখা শেষ করা যাক। তিনি উচ্চারণ করেন- O my body, make of me always a man who questions! 

 

লেখক: শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

 

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032029151916504