বিশ্বের অন্যতম আদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। অক্সফোর্ডের জন্ম ঠিক কবে, তা হলফ করে বলা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে যে, খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকেই এর যাত্রা শুরু। তবে অক্সফোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ১০৯৬ সাল থেকে। রোববার (৫ এপ্রিল) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, অক্সফোর্ড একটি অতি প্রাচীন বিদ্যাপীঠ হলেও আগে এর তেমন নামধাম ছিল না। তখনকার দিনে ইংরেজ ছেলেরা নিজ দেশ ছেড়ে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় জমাত। বিদেশ বিভুঁইয়ে ইংরেজ ছেলেদের দিনকাল ভালোই কাটছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হ্যানরি (১১৩৩-৮৯) ইংরেজ ছেলেদের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে মানা করে দিলেন। বেচারারা আর যায় কোথায়, উপায় না দেখে নিজ দেশের সেই অখ্যাত অক্সফোর্ডে ভিড় জমাতে শুরু করল। আর এ থেকেই শুরু হলো অক্সফোর্ডের নতুন পথচলা।
নিজের দেশে মায়ের ভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগের আনন্দটাই আলাদা। এখানে কেউ আর বাধা দেবে না, কেউ তাড়িয়ে দেবে না, শুনতে হবে না কারও মানা। কিন্তু না, এ সুখও বেশিদিন স্থায়ী হলো না, আরেকবার মাথায় শনির আঘাত। অক্সফোর্ডের ছাত্র ও শহরবাসীর মধ্যে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। এতে রাগে-ক্ষোভে বেশ কিছু শিক্ষক অক্সফোর্ড ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেই ভাবনা সেই কাজ, অভিমানী শিক্ষকরা অক্সফোর্ড ছেড়ে লন্ডন থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে ক্যাম নদীর তীরে নতুন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। শুরু হলো প্রাচীন আরেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা, যা আজকের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ শুধু ইউরোপের নয়, তামাম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন দুটি বিদ্যাপীঠ। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, পৃথিবীর আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অক্সফোর্ডেরই আন্ডাবাচ্চা! খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদি বিদ্যাপীঠ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জন হার্ভার্ড (১৬০৭-১৬৩৮) ক্যামব্রিজেরই প্রাক্তন ছাত্র।
অক্সফোর্ড থেকে ক্যামব্রিজের জন্ম ঝগড়ার মাধ্যমেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, এদের মধ্যে রয়েছে হরেক রকমের মিল। এ দুটিকে একত্রে বলা হয় অক্সব্রিজ। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের কথা বললে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কেই বোঝায়। অর্থাৎ অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ হলো বিশ্ববিদ্যালয় নগরী। প্রায় একই ধরনের ভর্তি প্রক্রিয়া, ডিগ্রি, সমাবর্তনসহ উভয়ের রয়েছে একই নামের একাধিক কলেজ। এছাড়াও রয়েছে কমন ডিবেটিং সোসাইটি, কমন বোটানিক্যাল গার্ডেন, কমন মিউজিয়াম, কমেডি গ্রুপসহ আরও অনেক স্থাপনা।
অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের ঝগড়ার ইতিহাস মনে রাখতে আয়োজন করা হয় মজার এক ইভেন্ট নৌকাবাইচ। এর আসর জমে লন্ডনের টেমস নদীতে। প্রায় চার মাইল দীর্ঘ এ ইভেন্ট দেখতে প্রতি বছর ভিড় জমায় হাজার হাজার মানুষ। প্রতিযোগিতার আয়োজক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি বোট ক্লাব ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি বোট ক্লাব। পুরুষ ও নারীদের জন্য পৃথক আয়োজন। তবে পুরুষ ইভেন্টটি সবচেয়ে পুরোনো। এর জন্ম ১৮২৯ সালে হলেও ১৮৫৬ থেকে প্রতি বছর এর আসর জমে আসছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খেলা বন্ধ থাকে। নারী ইভেন্টের শুরু অনেক পরে ১৯২৭ সালে। এটিও ১৯৬৪ সাল থেকে নিয়মিত হয়ে আসছে। ২০২০ সালের ২৯ মার্চের রোববারের পড়ন্ত বিকেলে ইভেন্টের দিনক্ষণ ঠিক ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে বাতিল করা হয়। টেমস নদীর দুই তীরে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখের বেশি দর্শক সরাসরি এ প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন। আর টিভির পর্দায় চোখ রাখেন আরও কমপক্ষে এক কোটি অনুরাগী। বিবিসি রেডিও ও বিবিসি টেলিভিশন প্রায় একশ' বছর ধরে এ প্রোগ্রামটি নিয়মিত সম্প্রচার করে আসছে। এ নৌকাবাইচ নিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঝুলে আছে আরও মজার মজার হরেক রকম কাহিনি।
লেখক : ড. মোহাম্মদ মজিবুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক