প্রসঙ্গ ইসলাম : বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদান - দৈনিকশিক্ষা

প্রসঙ্গ ইসলাম : বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে : খালাকাল ইনসানা আল্লামাহুল বাইয়ান- তিনি (আল্লাহ) মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাকে মনের ভাব প্রকাশ করার শিক্ষা দিয়েছেন (সূরা আর রহমান : আয়াত ৩-৪), আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি। (সূরা ইব্রাহিম : আয়াত ৪), আর তাঁর (আল্লাহর) নিদের্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে- আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। (সূরা রুম : আয়াত ২২)। শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তথ্য জানা যায়।  

নিবন্ধে আরও জানা যায়,  কোরআন মাজিদের এসব নির্দেশনা মুসলিম মননে প্রত্যেক জাতি বা সম্প্রদায়ের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান ও মর্যাদাদানের স্পৃহা গেঁথে দেয় এবং ইসলাম যেখানেই গেছে সেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে।

বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পূর্বে এখানকার অধিবাসীদের কথা বলার বুলি দারুণ অবহেলিত অবস্থায় ছিল। ডক্টর শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন : মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমণীর ন্যায় দিনহীন বেশে পল্লী কুঠিরে বাস করিতেছিল। বাঙ্গালা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। প-িতেরা নস্যাদার থেকে নস্য গ্রহণ করে শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করতে ছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র’ কিংবা ‘পাত্রাধার তৈল’ এই লইয়া ঘোর বিচারের প্রবৃত্ত ছিলেন। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে প-িতম-লী দুর দুর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, বঙ্গভাষা সুধী সমাজের কাছে অপাঙক্তেয় ছিল, ঘৃণা, অনাদার ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গালা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। (দ্রঃ শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব)।

প্রাচীন বাংলার উৎস-স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ চর্যাপদকে চিহ্নিত করেছেন। এই চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যেই বন্দীদশায় ছিল, তাকে বাংলা ভাষা বলাও দুরূহ। বাংলা ভাষায় যখন থেকে আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ ভাষার তাগিদেই ব্যবহার হতে লাগল তখন থেকে এ ভাষা প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত ভাষা হিসেবে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে লাগল। মুসলিম শাসনে এসে তা প্রাণচাঞ্চল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। ডক্টর আহমদ শরীফ মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাংলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হলো।

এখানে উল্লেখ্য যে, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির পর থেকে আরবের বাইরের ভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয়, যার ব্যাপকতা সঞ্চারিত হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদায় হজের পরবর্তীকালে। ওই সময় চীন-সুমাত্রাগামী আরব বাণিজ্য নৌজাহাজে করে প্রচুর পা-িত্যের অধিকারী কোন কোন সাহাবি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে সফর বিরতি দিয়ে এখানে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেননি। তাঁদের কারও কারও মাজার শরীফ এখনও চীনের ক্যান্টন নগরীর ‘ম্যাসেঞ্জার মসজিদ’ প্রাঙ্গণে রয়েছে। এ্যানসেসটরস গ্রেভইয়ার্ড নামে তা পরিচিত।

বাংলাদেশে ব্যাপকহারে ইসলাম প্রচার শুরু হয় দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাদি আল্লাহু তাআলা আনহুর খিলাফতকালের মধ্যভাগ নাগাদ অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তারপর থেকে এখানে দলে দলে আরব, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, মিসর, ইয়েমেন, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ইসলাম প্রচারকের আগমন ঘটে। তাঁরা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। এসব প্রচারক বাংলাদেশের মানুষের ভাষা শিখে সেই ভাষাতেই ইসলামের শিক্ষা, সৌকর্য সবার সামনে তুলে ধরেন। তখন থেকেই আরবি, ফারসী, তুর্কি শব্দ বাংলা ভাষায় আত্মভূত হয়ে এদেশের মানুষের মুখের ভাষার অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা প্রকৃত অবয়ব লাভ করে এরই ফলে।

বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে। মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার আগে এখানে যেসব রাজার শাসন ছিল তারা বাংলা ভাষাকে নিষিদ্ধ ভাষা করে দিয়েছিল। বলা হয়েছিল : অষ্টাদশ পুরাণাদি রামস্য চরিতানিচ/ভাষায়াং মানব : শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ- অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ, রামচরিত ইত্যাদি মানব ভাষায় (বাংলা) চর্চা করলে রৌরব নরকে যেতে হবে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই (১২০১ খ্র্রি.) বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার সুদূরপ্রসারী দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার আস্বাদনেও নিজেদের অভিষিক্ত করতে সমর্থ হন। বাংলার মুসলিম শাসকগণ বাংলার মানুষের খাদিম বা সেবক হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এসব শাসক সুলতান অভিধায় অভিহিত ছিলেন, তারা শাহে বাঙ্গালা, সুলতানে বাঙ্গালা খেতাবে ভূষিত ছিলেন এবং এ দেশের মানুষের জাতীয় পরিচয় ছিল বাঙ্গালিয়ান। এটাই সত্যি যে, স্বাধীন বাঙ্গালা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানি আমলেই।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আজকে যে সুবিস্তৃত দিগন্তব্যাপী ঔজ্জ্বল্য, এই যে জগৎজোড়া খ্যাতি ও সমৃদ্ধি-সৌরভে সমুজ্জ্বল তার স্থপতি নির্ণয়ে আমাদের যেতেই হয় বাংলার সুলতানি আমলে। আর সেই সুলতানি আমলই হচ্ছে বাংলার সোনালি যুগ। সে যুগ যেমন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সোনালি ছিল, তেমনি সামাজিক উন্নতির দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শান্তি ও সমৃদ্ধির দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়েও যেমন সোনালি যুগ ছিল, তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরও সোনালি যুগ ছিল।

বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় সুলতানগণ বাংলার সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণগণ বাংলা ভাষা চর্চার প্রবল স্রোতকে রোধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃত্তিবাস রামায়ণ এবং কালিদাস মহাভারত অনুবাদ করলে ব্রাহ্মণ প-িতরা তাদের রৌরব নরকের অধিবাসী বলেই ক্ষান্ত হননি, তারা একটি বচন বানিয়ে জনগণের মধ্যে তা ছড়িয়েও দেন। আর তা হচ্ছে : কৃত্তিবেশে কালীদেসে আর বামুন ঘেঁষে/এই তিন সর্বনেশে।

মুসলিম লেখকগণ বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে পুঁথি সাহিত্যের বিরাট আঙ্গিনা নির্মাণ করেন। সুলতান ইউসুফ শাহের দরবার কবি জৈনুদ্দীন এবং শাহ বিরিদ খান পৃথক পৃথক রসূল বিজয় কাব্য রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে সৈয়দ সুলতান বাংলা ভাষায় মহাকাব্য রচনার সূত্রপাত ঘটান। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের মতে সৈয়দ সুলতানের নবী বংশ নামক পুঁথিখানি হচ্ছে বাংলা মহাকাব্যের মহান আদর্শ। সৈয়দ সুলতান সূরা ইবরাহিমের ৪ নম্বর আয়াতে কারিমার আলোকে বলেন।

আল্লায় কহিছে মোরে দেশের যে ভাষ

সে দেশে সে ভাষে কৈলুম রছুল প্রকাশ

এক ভাষে পয়গম্বর আর ভাষে নর

না পারিব বুঝিবারে উত্তর সদুত্তর

যথেক রছুল নবী পয়গম্বর হৈছে

উম্মতের যে ভাষা সে ভাষে সৃজিয়াছে ॥

চলবে...

লেখক : অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম, পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ।

নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039739608764648