প্রসঙ্গ : পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা - দৈনিকশিক্ষা

প্রসঙ্গ : পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা একদম দোরগোড়ায়। তারিখ পরিবর্তন না হলে কাল থেকেই শুরু হবার কথা ছিল। বেশ ক’ বছর যাবৎ ১ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষাটি শুরু হয়ে থাকে। জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ পাঠ্যপুস্তক দিবস আর ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ এসএসসি পরীক্ষা শুরু। এভাবে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবার মাইন্ড সেটআপ হয়ে আছে। কিন্তু এবার প্রথম এর ব্যত্যয় ঘটলো। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের তারিখ এসএসসির এক সপ্তাহ আগে কিংবা পরে হলে এমন কী হতো? গঙ্গা অশুদ্ধ হবার তো কিছু দেখি না। ২০২০ শিক্ষাবর্ষের ছুটির তালিকায় ৩০ জানুয়ারির পরিবর্তে ২৯ তারিখ শ্রী শ্রী সরস্বতী পূজা দেখিয়ে ছুটির দিন যারা নির্ধারণ করেছিল, তারা ভুলে নাকি অন্য কোনো কারণে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এমনটি করেছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি করে এর আসল কারণ উদ্ঘাটন করা অপরিহার্য। নির্বাচন কমিশনের খামখেয়ালি থেকে থাকলে সেটিও ধরে দেখিয়ে দেয়া প্রয়োজন। নির্বাচন, সরস্বতী পূজা ও এসএসসি পরীক্ষার সিডিউল উপর্যুপরি হবার কারণে অবশেষে পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখটি বলি দেয়া হলো। পরীক্ষার চেয়ে নির্বাচনকে অধিক গুরুত্ব দুনিয়ায় আর কেউ দেয় কি না জানি না। তবে আমাদের এ দেশে পলিটিক্স আর পলিটিশিয়ানের গুরুত্ব সবার চেয়ে বেশি। অবশেষে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য নিরন্তর শুভ কামনা জানিয়ে দেশে প্রচলিত পরীক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আজ দু’ চারটে কথা বলতে চাই। এ নিয়ে আজ প্রথম নয়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় মুখেও বলেছি এবং কলমেও লিখেছি। কিন্তু কে শুনে কার কথা?

ছোটবেলা বাড়িতে ও স্কুলে পেন্সিল দিয়ে স্লেটে লিখতাম। মনে আছে, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্লেট দিয়েই রাফখাতার কাজ সেরেছি। আজকের শিশুরা স্লেট-পেন্সিল চেনে না। চেনার কথা নয়। অনেকে হয়ত নামও শুনেনি। ঝর্ণা বা ফাউন্টেন পেন খুব জনপ্রিয় ছিল। এরপর ইয়ুথ (Youth) কলম যখন বের হলো, তখন থেকে ঝর্ণা কলম আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। প্রথম যখন বের হয়, তখন একটি ইয়ুথ কলম পাবার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। অনেক পরে যেদিন সেটি হাতে পাই, সেদিনের আনন্দ কে দেখে? একটি হারানো রাজ্য ফিরে পেলে যে রকম মনের অবস্থা হয়, সেদিন ঠিক সে রকমই হয়েছিল। ইয়ুথ বলি আর ফাউন্টেন বলি, এসব কলমে কালি ঢুকিয়ে লিখতে হতো। দোয়াতের ভেতর কালি থাকতো। আবার কালির পাউডারও কিনতে পাওয়া যেত। পানিতে পাউডার মিশিয়ে কালি বানানো যেত। কালির দোয়াত সবার কাছে পরিচিত ছিল। সে সময়ে স্থানীয় পর্যায়ের যে কোনো নির্বাচনে ‘দোয়াত কলম’ একটি জনপ্রিয় প্রতীক ছিল। সেই জনপ্রিয় প্রতীকের দোয়াতটি আজ মনে হয় নতুন প্রজন্মের অনেকেই চেনে না। আর কলম চিনলেও আজকাল যে কলম বাজারে পাওয়া যায়, সেদিন তা ছিল না। সেদিনের ইয়ুথ আর ফাউন্টেন কোথায় যে হারিয়ে গেছে, সে খবর আজ কারো জানা নেই। এক সময় A Foutain Pen একটি গুরুত্বপূর্ণ Paragraph ছিল। পরীক্ষার জন্য সবাই মুখস্ত করে রাখতো। আজ আর সে Paragraph টিও নেই।

আমাদের শিক্ষায় এতদিনে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরীক্ষায় তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। পঞ্চম শ্রেণিতে পিইসি আর অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষা চালু করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার নিচে চাপা মেরে রাখা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের বোঝা আর পরীক্ষার ধকলে পড়ে শিশু শিক্ষার্থীদের বারোটা বেজে যাচ্ছে, সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। পৃথিবীর অনেক দেশে যেখানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই নেই, সেখানে আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষার আদলে দুই দুটো পরীক্ষা অর্থ ও সময়ের অপচয় বৈ কিছু নয়। সেটি ভেবে দেখার সময় হয়েছে। কেবল তাই নয়। আমাদের গোটা পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তা না হলে দিনে দিনে পরীক্ষার সব আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

পরীক্ষার ধরন না পাল্টালে গতানুগতিক ধারার পরীক্ষায় আজ তেমন সুফল নেই। পরীক্ষায় নকল প্রবণতা, প্রশ্নফাঁস, দেখাদেখি করে লেখা, পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা, উত্তরপত্র মূল্যায়নে নির্ভরযোগ্যতার অভাব, খাতা পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ না থাকা, যেখানে সেখানে পরীক্ষা কেন্দ্র থাকা ইত্যাদি নানা কারণে গোটা পরীক্ষা ব্যবস্থাই আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বর্তমান ধারার পরীক্ষার কারণে নোট-গাইড অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কোচিং বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। শিক্ষা এখন বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকের নৈতিকতায় চিঁড় ধরেছে। ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ক তিক্ততায় গড়িয়েছে। তাই এখন পরীক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যেমন নতুন করে চিন্তা করতে হবে তেমনি পরীক্ষা ব্যবস্থা নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন করে ডিজাইন করতে হবে। তা না হলে প্রচলিত পরীক্ষা ব্যবস্থা অন্যদের কাছে তো বটে, আমাদের নিজেদের কাছেও দিনে দিনে এক মস্ত বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে উঠবে।

আইসিটি ও কারিগরিভিত্তিক শিক্ষা চালু করে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ও পরীক্ষা উভয় ধারায় পরিবর্তন আনয়ন করা যায়। হাতে-কলমে যে শিক্ষা অর্জন করা যায়, সে শিক্ষার আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে না পারলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার উপযোগী শিক্ষা ধারায় অনুপ্রবেশ করতে হবে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করে যেমন মুখস্ত করার প্রবণতা অনেকটা হ্রাস করা গেছে, তেমনি আইসিটি ও কারিগরিভিত্তিক শিক্ষা চালু করে প্রচলিত ধারার পরীক্ষা থেকে বেরিয়ে আসা এখন সময়ের অন্যতম দাবি। কেবল পরীক্ষা পাসের জন্য লেখাপড়া নয়, আগামীর উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা অপরিহার্য মাধ্যম-এই ধারণাটি আমাদের সবার মনে জাগিয়ে দিতে হবে। যে শিক্ষা চাকরি নয়, আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বের করে দিতে সাহায্য করে সেটির আজ বড় বেশি দরকার।

আমি একদম পরীক্ষা উঠিয়ে দেবার কথা বলি না। আজকাল আমাদের পরীক্ষা বেশি মাত্রায় আনুষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। তাই অনানুষ্ঠানিক তথা শ্রেণি টেস্টের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।। তবে ইদানিং ধারাবাহিক মূল্যায়নের (CA) মাধ্যমে কতটুকু সুফল পাওয়া যাচ্ছে, সে বিষয়ে আমার অন্তত সন্দেহ রয়েছে।

একেকটা বিষয়ে তিন ঘণ্টা পরীক্ষা না নিয়ে এক-দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। ১০০ নম্বরের পরীক্ষা না নিয়ে ৩০ কিংবা ৩৫ নম্বরের পরীক্ষা নিয়েও মেধা যাচাই করা যায়। সৃজনশীল ১টি মাত্র প্রশ্ন দিয়ে বাকি সব বহু নির্বাচনি প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করলে প্রশ্ন প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত হবে। সারা বছর ধরে ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা আয়োজন না করে পুরো ডিসেম্বর কিংবা অন্য যে কোনো একটি মাসে সব পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। এক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা শেষ করা যায়। তা না হলে সারা বছর ধরে কোনো না কোনো পরীক্ষা থাকে। এতে লেখাপড়ার বিঘ্ন ঘটে। এমনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে পিইসি, জেএসসি, এসএসসসি সবগুলো পরীক্ষাই অনুষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কখন লেখাপড়া হয়, কে জানে?

আরেকটি বিষয়ে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। আর তা হলো এই, পরীক্ষার আনুষ্ঠানিক চেহারা পরিবর্তন করার জন্য এর ফল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ না করে এসএমএসের মাধ্যমে যার যার মোবাইলে জানিয়ে দেয়া যায়। পরীক্ষার একটা টাইমলাইন জানা থাকলে  রুটিন এত আগে-ভাগে প্রকাশ করার দরকার নেই। পরীক্ষার পাঁচ কিংবা সাতদিন আগে রুটিন প্রকাশ করলে প্রশ্ন ফাঁসকারীরা কিছুটা হলেও হোচট খাবে। আজকাল তথ্য প্রযুক্তির যুগ। পরীক্ষার রুটিন, ফল প্রকাশ ও অন্যন্য কার্যক্রমে কেবল ই-মেইল ও এসএমএসের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। সংবাদপত্র কিংবা অন্যান্য মিডিয়ায় পরীক্ষার খবর ফলাও করে প্রচার হলে প্রশ্ন ফাঁসকারী এবং পরীক্ষা নিয়ে যারা অসৎ ব্যবসা করে, তাদের বেশি সুবিধা হয়। আগেভাগেই এরা তৎপর হয়ে উঠে। অপতৎপরতা শুরু করে দেয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাববার এখন উপযুক্ত সময়। 'শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'- স্লাগানটি কেবল মুখে উচ্চারণ করে নয়, বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। মুজিববর্ষে এই হোক আমাদের সবার একান্ত প্রত্যয় ও দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক  :  অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061938762664795