উকিপিডিয়ার তথ্যমতে, শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে 'শাস' ধাতু থেকে। যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ education এসেছে ল্যাটিন শব্দ educare বা educatum থেকে। যার অর্থ to lead out অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।
সক্রেটিসের ভাষায় 'শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ। এরিস্টটলের মতে '' সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা’'। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে’।
এ থেকে স্পষ্ট, শিক্ষা কোন সাধারণ বিষয় নয়। আর একটি আসাধারণ বিষয়কে সাধারণ, সাবলীল ভাবে যিনি তুলে ধরেন তিনি শিক্ষক। শিক্ষা যখন শিক্ষকের দ্বারা বানিজ্যিকরণ হয়ে যায়, তখন এরিস্টটল ও রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিও শিক্ষার স্বরুপ বিশ্লেষনে ব্যার্থ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আসাধু মানুষরূপি আমানুষ শিক্ষাকে পণ্য বানানোর উদ্দেশ্যে উঠে-পড়ে লেগেছে। এসব অমানুষদের চেনা কঠিন, কারণ তারা দেখতে মানুষের মতোই।
প্রাইভেট কারা পড়ান? কেন পড়ান? অভিভাবকরা কেন পড়তে দেন? এক ব্যাচে কতজন পড়লে তাকে প্রাইভেট পড়া বলা হয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। ছাত্রজীবনে অনেকেই প্রাইভেট পড়ান নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য। এটা দোষের কিছু নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন পান না। তারা প্রাইভেট পড়ান। ছাত্রজীবনে প্রাইভেট পড়ালে জ্ঞানকোষ উর্বর হয়। আমার মতে প্রাইভেট পড়ানো প্রথার ব্যাবহার তাদের জন্যই হওয়া উচিৎ। যে শিক্ষক সত্যিকার অর্থে জ্ঞান বিতরণের উদ্দেশ্যে প্রাইভেট পড়ান তিনি একটি ব্যাচে ১০ থেকে ১২ জনের বেশি পড়ান না। কিন্তু একজন বেতনভুক্ত শিক্ষক যদি ৭০ থেকে ৯০ জন শিক্ষার্থী এক ব্যাচে প্রাইভেট পড়ান তখন তাকে শিক্ষা বাণিজ্য ছাড়া আর কোনভাবে সঙ্গায়িত করা যায় না।
সমাজে অনেক ধরনের প্রতারক চক্র আছে। কেউ খাবারে কিছু মিশিয়ে কাউকে সর্বস্বান্ত করে। এদেরকে বলা হয় অজ্ঞান পার্টি। আবার কেউ অন্যের চোখে মলম দিয়ে সব কিছু কেড়ে নেয়। এদের বলা হয় মলম পার্টি। কিন্তু যারা জ্ঞান ও শিক্ষা দেয়ার নামে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তাদের কি জ্ঞান পার্টি বললে ভুল হবে কি? এই জ্ঞান পার্টির জনবলই প্রাইভেট ও কোচিং বানিজ্যের সাথে জড়িত শিক্ষা ধ্বংসকারী অসাধু কিছু শিক্ষক। শুধু তাই নয়, এই প্রতারক চক্রকে শক্তিশালীকরণের লক্ষে তারা গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এলাকাভেদে এই সিন্ডিকেটের সদস্য পাঁচ-ছয়জন, যারা পাঁচ-ছয়টি বিষয়ের শিক্ষক।
একজন কোমলমতি শিক্ষার্থী যদি এই চক্রের একজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য যায়, তাহলে তাকে যেকোনভাবে মগজ ধোলাই করে সিন্ডিকেটের বাঁকি শিক্ষকদের কাছে পড়তে বাধ্য করা হয়। এই মগজ ধোলাইয়ের শিকার শুধু শিক্ষার্থীই হয় না। অভিভাবকদের সাথেও একই প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করা হয়। বিজ্ঞানের শিক্ষকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেট করেন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সাথে। কারণ এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।
বিজ্ঞান শিক্ষক সিন্ডিকেট চক্রের বড় হাতিয়ার ব্যবহারীক পরীক্ষার নম্বর। ব্যাবহারীক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার আশায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এসব প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দেয়। এভাবেই অভিভাবকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট চক্র। স্বাভাবিক অর্থে, একজন শিক্ষক যদি তার বেতনের টাকায় পরিবারের ব্যায়ভার বহন করতে না পারেন, তখন তিনি প্রাইভেট পড়ান এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কাছ থেকে বোঝার অপূর্ণতা থাকলে শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে। কিন্তু এই চিত্র আজ বিচিত্র।
যে সমস্ত শিক্ষকগণ এই রকম সিন্ডিকেটের সদস্য, তারা হয়তোবা আমার লেখা পড়ে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছেন। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখেন না!? আমার কথাগুলো অযৌক্তিক কিনা। আপনাদের কাছে যদি অযৌক্তিক মনে হয় তবে তা যুক্তিখণ্ডনসহ জানানোর অনুরোধ রইলো। আমি পুরোপুরি প্রাইভেটের বিপক্ষে না। নিয়ম মেনে প্রাইভেট পড়ালে আপনার সমস্যা কোথায়? বর্তমান সরকার শিক্ষকদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। করে যাচ্ছেন। আগের তুলনায় বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে পরিষ্কার, স্বচ্ছ নিয়ম হয়েছে। তাহলে কেন আপনি শিক্ষাকে পণ্য বানানোর অপচেষ্ঠা চালাচ্ছেন। শুধু ভেবে দেখুন অতীতের চেয়ে আপনার বর্তমান ভালো যাচ্ছে কি না? এখন আপনি যদি ভাবেন আগে বাইসাইকেলে চড়তাম। এখন হেলিকাপ্টারে চড়ে বেড়াবো। এক্ষেত্রে নীতি বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কোন পথ আছে বলে আমার জানা নাই। আপনারা এতোক্ষণে নিশ্চয় ভেবে ফেলেছেন, আমি সরকারদলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত। কিন্তু আমি ব্যাক্তিগতভাবে কোন রাজনীতির সাথেই যুক্ত নই। আমি আমার আত্মিক দর্শনের সাথে যুক্ত। আমি কারও দ্বারা উপকৃত হলে, প্রাণখুলে তা স্বীকার করে মনোতৃপ্তি পাই। এজন্যই এ কথাগুলা বলা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আগে থেকেই শুরু হয় শিক্ষার্থীর প্রাইভেট পড়া। প্রতিযোগীতার যুগ বলে কথা ! সমাজের সিন্ডিকেট শিক্ষকদের প্রতারণার কালো হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার কেউ নেই। এদের হাত অনেক লম্বা। সারাদেশের শিক্ষার্থী আজ প্রাইভেট কোচিং রোগে ভয়াবহ আক্রান্ত। যারা এসব সিন্ডিকেট, প্রাইভেট বানিজ্য প্রতিরোধ করবেন, তাদের সন্তানরাও যে প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে! সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার। ২০১২ সালেও চেষ্টা করেছিলেন। কোন লাভ হয়নি। বরং প্রাইভেট পড়ার বেতন বেড়ে গিয়ে তিনগুন হয়েছে। অভিভাবকদের প্রতিমাসে গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত অনেক টাকা। ২০১২ তে একবার অভিভাবকরা জিম্মি হয়েছে এই সমস্ত প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে। এবার আরও একবার জিম্মি হওয়ার অপেক্ষায়!? নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
লেখকঃ শিক্ষক ও কলামিস্ট