প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে কতটা মানুষ করে? - দৈনিকশিক্ষা

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে কতটা মানুষ করে?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রতিটি স্কুলে সহবত শিক্ষা দেওয়া হয়। ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’-এর একটি রুল বুকও দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের পর এই রুল বুকের কত শতাংশের প্রতিফলন ঘটতে দেখি? ভুল হবে না যদি বলি ৯০ শতাংশই মানা হয় না। স্কুলগুলো কি তবে তোতাপাখি বানানোর মেশিন একেকটি? কিছুদিন পরপরই নতুন নতুন স্কুল গজিয়ে উঠতে দেখি। এর কোনোটির নাম দেওয়া হয় ইংরেজি রাইমসের অংশ নিয়ে, কোনোটি বাইবেলের কোনো সেইন্টের নামে। ইংরেজি বা বাংলা মাধ্যম বলে কথা নয়, সব স্কুলই এখন মুখস্থবিদ্যার কারাগার। ডান-বাম কোনোদিকে না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে কেবল পড়া মুখস্থ করান হয় সেখানে। মুখস্থ শিক্ষা আত্মস্থ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাই নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীই যে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে সে নিশ্চয়তা নেই। শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, পরনে ব্র্যান্ডেড পোশাক, সর্বশেষ ভার্সনের স্মার্ট ফোন হাতের মানুষটিকে যখন রাস্তার মধ্যে প্লাস্টিকের প্যাকেট, পানির বোতল, সিগারেটের টুকরো ফেলতে দেখি তখন বুঝতে পারি ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’-এর রুলটি মুখস্থ হয়েছে, আত্মস্থ হয়নি। এরাই ইউরোপের রাস্তাঘাটের সঙ্গে বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের তুলনা করে আক্ষেপ করে। নগরের নীতিনির্ধারকরা বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের কথা বলছেন। অথচ চলতি পথে নব্বই শতাংশ পথচারি তাদের হাতে থাকা অপ্রয়োজনীয় জিনিসটি ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলছেন। প্রাথমিক নজরদারি কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা নেই। এভাবে কি পরিচ্ছন্ন দূষণহীন চোখ জুড়ানো শান্ত স্নিগ্ধ সবুজ সতেজ নগরী তৈরি করা সম্ভব?

নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থেমেছে কি থামেনি আমরা হুড়মুড়িয়ে নামি ঐ একই গতিতে ওঠারও চেষ্টা করি। আমলে আনি না পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বর্ষীয়ান বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের প্রয়োজনকে। প্রাধান্য দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই। গণপরিবহনে অসুস্থ কেউ আছে কি না তার তোয়াক্কা না করেই লাউড স্পিকারে গান শুনি। অন্য যাত্রীদের অসুবিধাকে থোড়াই কেয়ার করে মোবাইলে চিত্কার করে কথা বলি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চারপাশে ছড়িয়ে আছে সংক্রমণের নানা শঙ্কা। অজান্তেই আমরা নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস বহন করে যাচ্ছি। শুধু বর্ষাকাল নয় ভাইরাস থেকে রোগের প্রকোপ এখন সারাবছর। সর্দি-কাশি বা মুখের যে কোনো সিক্রেশন স্যালাইভা থেকে পাশে থাকা যে কেউ সংক্রমিত হতে পারেন। অথচ হাঁচি-কাশি পেলে মুখে রুমাল টিস্যু চাপা দিই না।

নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ঘণ্টাখানেক দেরিতে পৌঁছে দুঃখিত হওয়ার পরিবর্তে অনায়াসে তৈরি করে ফেলি যে কোনো অজুহাত। ‘সময়কে ম্যানেজ করা মানে জীবনকে ম্যানেজ করা’—বইয়ে পড়া বাক্যটি ভুলে যেতে পারলেই যেন বাঁচি। তাই কোনো জায়গাতেই নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে পারি না। কথা বলার দক্ষতা আয়ত্তে আনার জন্য নানা রকম ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। কিন্তু সামাজিক পরিবেশের অসহিষ্ণুতা বিবেচনা করলে দেখা যায় কথা বলার চেয়ে শোনার দক্ষতা অর্জন করা এখন আরো বেশি জরুরি। অথচ আমরা কেউ কারো কথা শুনি না। কথা শোনাটাকে বোধহয় আমরা নিতান্ত গৌণ কাজ মনে করি। সামাজিক জীবনে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যেত যদি আমরা এক জন আরেক জনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। দেখা যাচ্ছে গ্রন্থগত বিদ্যা গ্রন্থেই আছে। বই থেকে শেখা সহবত দৈনন্দিন জীবনে মানি না। আবার ছোটোখাটো অসতর্কতায় ডেকে আনি অনেক বড়ো বড়ো বিপদ। যে কোনো কাজের প্রত্যেকটি ধাপে ক্রস চেকিং দরকার, আমরা তা করি না। উত্পাদন এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না দেখে পণ্য কিনে মাঝেমাঝেই মাশুল দিই।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের বন্ধুর সঙ্গে প্রতিযোগীমুখী করে কিন্তু বন্ধুর কৃতিত্বে ভাগ নিতে শেখায় না। নইলে সোশ্যাল মিডিয়ায় যার বন্ধুর সংখ্যা হাজার হাজার, মাইক্রো ব্লগিং সাইটে যার অনুসারী গুনে শেষ করা যায় না, কেন তিনি প্রয়োজনে বন্ধুদের পাশে পান না ? কেন একের বিপদে অন্যের সশরীরে পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা কমে আসছে? বন্ধুত্বে প্রাথমিক শর্ত কি এসব মাধ্যমে পূরণ হয় ? বন্ধুর বেশে শত্রুর মতো সাইবার ক্রাইম ঘটিয়ে যাওয়ার ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব দেখে মনে হয় আশি-নব্বই দশকের পারিবারিক মূল্যবোধ নিতান্ত মূল্যহীন ছিল না। টিন-এজারদের নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফেরার অনুশাসন কি একদমই অপ্রয়োজনীয়? মাঘ সংক্রান্তি থেকে চৈত্র সংক্রান্তির দুই মাস সজিনা, করলা, উচ্ছে, তেতো খাওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ছিল আজ বুঝি তা কতখানি স্বাস্থ্যবান্ধব ছিল। হার্টের সমস্যা ক্রমে বেড়েই চলছে কম বয়সিদের মধ্যেও।

কার্ডিও ভাসকুলার ও কার্ডিও থোরাসিক সার্জনরা বলছেন শুধু হার্টের সমস্যা নয়, দেখা দিচ্ছে টাইপ টু ডায়াবিটিস এবং নানাবিধ লাইফস্টাইল ডিজিজ। উচ্চমানের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সবসময় সুখের যথাযথ মানদণ্ড নয়। সুখী হওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভালো মানুষ, সমব্যথী, সহমর্মী হওয়ার ইচ্ছা, অন্যের ব্যথা-যন্ত্রণা, কষ্টের জায়গা বুঝতে পারার সমানানুভূতি। অথচ এমন এক সমাজে আমরা থাকি যেখানে নিজেকে সুখী হতে হলে অন্যকে দুঃখ দিতেই হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে হয় আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ। কিন্তু তাই বলে শিক্ষা ঐ সাড়ে তিন হাত হলেই চলে না। সাড়ে তিন হাত শিক্ষার মধ্যে মন যথেষ্ট পরিমাণ বেড়ে উঠতেও পারে না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:‘শিশুকাল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে দ্রুতবেগে পড়া মুখস্থ করিয়া গেলে নিতান্ত আবশ্যক কাজ চলে। কিন্তু তাহাতে বিকাশ লাভ হয় না।’ সম্ভবত সে কারণে আমরা একেকটি তোতাপাখি হয়ে উঠেছি, মানুষ হতে পারিনি।

লেখক : জয়া ফারহানা, প্রাবন্ধিক

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075139999389648