প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল

মোহাম্মদ ইব্রাহিম তালুকদার |

বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি বৃদ্ধি, ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার মানবৃদ্ধি ও উন্নয়মূলক কর্মকান্ডে ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃত্ত করলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যালয় আঙিনা পরিষ্কার, খাবার পানি সংগ্রহ, আসন বিন্যাস, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, শিক্ষা উপকরন সরবরাহ, বিদ্যালয়ে বাগান তৈরি ও পরিবেশ উন্নয়নসহ বিতর্ক আয়োজন এবং ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমূলক কর্মকান্ডে স্টুডেন্টস কাউন্সিল বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে।

শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত তৎপরতার স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নিকট থেকে বিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও সেবা সংগ্রহ করা সম্ভব। স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সহায়তায় ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য উদ্ধুব্ধকরণ সভা, হোম ভিজিট ও অভিাভাবকদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা উন্নয়ন এবং খেলার সরঞ্জামাদি সংগ্রহে শিক্ষার্থীরা ভূমিকা পালন করতে পারে।

নির্বাচনের মাধ্যমে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠিত হওয়ার পরেই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চাহিদার ভিত্তিতে বাৎসরিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার উৎসসমূহ চিহ্নিত করবে। অনুরূপ চর্চার মাধ্যমে তারা ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীগণ শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে।

এ লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের যে সব কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রাখতে পারে সে সব ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃত্ত করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে পারিবেশ সংরক্ষণ, পুস্তক ও শিখন সামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, পানি সরবরাহ/সংগ্রহ, বৃক্ষরোপন ও বাগান তৈরি এবং অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃত্ত করার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের ১৯টি জেলার ২০টি উপজেলার ১০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন, বিদ্যালয়ের শিখন শিখানো কার্যক্রমে শিক্ষকম-লীকে সহায়তা করা, বিদ্যালয়ে ১০০% ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধে সহযোগিতা করা, শিখন শিখানো কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকান্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্টুডেন্টস কাউন্সিলের গঠন।

স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কার্যক্রম স্থানীয় জনসাধারণ, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের মাঝে বিপুল আগ্রহ ও উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কার্যক্রম ২০১০ সনের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১১সনে পূর্ববর্তী বছরের ১০০টি বিদ্যালয়সহ সব মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের নির্দেশনা প্রদান করা হলে সারাদেশে ৭৪১টি বিদ্যালয়ে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠিত হয় যা ২০১২ সনে সারাদেশে সর্বমোট ১৩, ৫৮৩টি বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

২০১৩ সালে ৪৬,৭৭৩টি বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে ৬১,১৯১টি বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সাফল্যজনক কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

স্টুডেন্টস কাউন্সিল কার্যক্রম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সন থেকে সারাদেশের সকল উপজেলা/থানার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যা বর্তমানেও চলমান। তারই ধারাবাহিকতায় সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচন-২০১৯ অনুষ্ঠিত হয়। যার প্রথম ধাপ কর্মপরিকল্পনায় ছিল উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা কর্তৃক প্রধান শিক্ষক ও এসএমসি’র সভাপতিকে অবহিতকরণ, বিদ্যালয় পর্যায়ে এসএমসি, শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রী সমন্বয়ে অবহিতকরণ সভা, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও ভোটার তালিকা প্রকাশ ও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা আর দ্বিতীয় ধাপ নির্বাচন তফসিলে ছিল মনোনয়ন আহ্বান, মনোনয়ন জমা, মনোনয়ন বাছাই ও বৈধ প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ, মনোনয়ন প্রত্যাহার, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ এবং সর্বশেষে ভোট গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ যা একটি দেশের জাতীয় নির্বাচনের অনুরূপ।

বর্তমান সরকারের শাসনামলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, ডাকসু নির্বাচনের ন্যায় অন্য সব নির্বাচন বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য। এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচন একটি যুগান্তকারী, যুগোপযোগী, কার্যকরী ও গবেষণাধর্মী সিদ্ধান্ত যা সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সত্যিকার গণতান্ত্রিক চর্চা করার লক্ষ্যেই শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচন।

জাতীয় নির্বাচনের ন্যায় প্রার্থীর হলফনামা, আয় ব্যয়ের তথ্যবিবরণী, মাইকিং, মুদ্রিত পোস্টার লাগানো, প্রতীক বরাদ্দ ইত্যাদি না থাকলেও প্রার্থীর যোগ্যতা অযোগ্যতা, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন অফিসার, নির্বাচনী তফসিল, আচরণবিধি, প্রচারণা সবই ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচনে।

জরুরি সভা ব্যতিত স্টুডেন্টস কাউন্সিল প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার সভা করবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষকগণ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে কিন্তু কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে রয়েছে কোরাম প্রক্রিয়া। পদত্যাগের ব্যবস্থা তো রয়েছেই। আবার শূন্যপদে অধিক ভোটপ্রাপ্ত পরবর্তী প্রার্থীকে স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সদস্য অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা যা প্রায় জাতীয় সংসদের মত।

প্রাথমিক বিদ্যালয় স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচন-২০১৯ এ বিজয়ী একজন তাহারাত ইব্রাহিম। সে নারায়ণগঞ্জস্থ আমলাপাড়া আদর্শ শিশু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণী অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ৭ জনের মধ্যে সে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি। নির্বাচন পরবর্তী তার দায়িত্ব হয় ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী’ হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় একজন প্রধানতো রয়েছেনই।

বিদ্যালয়ের প্রধান ৭টি কার্যক্রমের দায়িত্বে নির্বাচিত ৭জন প্রতিনিধির মধ্যে তাহারাতের ন্যায় একজন খুদে মন্ত্রীর দায়িত্ব একজন জাতীয় মন্ত্রীর মতই। যদিও একজন জাতীয় মন্ত্রী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ব্যস্ত থাকেন আর প্রাথমিক বিদ্যালয় স্টুডেন্টস কাউন্সিলে নির্বাচিত মন্ত্রীর দায়িত্ব একটা স্কুলকেন্দ্রিক মাত্র। কর্ম-পরিসরের চেয়ে প্রধানতম বিষয় হলো দায়িত্ব। তাহারাত দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের স্বাস্থ্যসচেতনতায় সে অতিশয় ব্যস্ত। তার মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে অন্যরকম এক উচ্ছাস।

এই যে একজনকে একটি দায়িত্ব দিয়ে দায়িত্বশীল বানানো, এর চেয়ে এই সরকারের আর কি সাফল্য হতে পারে। তাঁকে কাজে সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে কয়েকজন অনির্বাচিত প্রতিনিধি। স্বাস্থ্যসচেতনতায় যা যা দরকার তা সবই করছে তারা। বাকি দায়িত্বে রয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ (বিদ্যালয়, আঙিনা ও টয়লেট পরিষ্কার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা), পুস্তক ও শিখন সামগ্রী, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, পানি সম্পদ, বৃক্ষ রোপণ ও বাগান তৈরি ইত্যাদি, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন। সর্বোপরি এদেরকে সহযোগিতা করার জন্য প্রধান শিক্ষক একজন সহকারী শিক্ষককে সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগ দেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বর্তমান সরকারের সাফল্যের তালিকা অনেক দীর্ঘ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠন সেই সাফল্যের দীর্ঘ তালিকার একটি। বাংলাদেশের চেয়ে আগে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি অর্থনীতির সূচকে অনেক এগিয়ে। তা সবই সম্ভব হয়েছে সরকারের আন্তরিকতা ও ধারাবাহিক উন্নয়ন। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, বেকারমুক্ত, সম্ভাবনাময় একটি শিক্ষিত, শৃংখলিত, সুখী, সমৃদ্ধিশালী, অঙ্গীকারাবদ্ধ ও উন্নত ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে এটাই আমাদের আশা।

লেখক : ব্যাংকার

সূত্র: সংবাদ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039520263671875