দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চালু হচ্ছে 'একীভূত শিক্ষা' কার্যক্রম। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের একসঙ্গে একই মানের পাঠদান নিশ্চিত করতে সরকারের শিক্ষাবিষয়ক দুই মন্ত্রণালয় পৃথক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সব উপজেলায় চালু করা হবে বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সব জেলায় নির্বাচিত একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একীভূত শিক্ষা চালু করা হবে।
শিশু শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, একীভূত শিক্ষা হলো একটি প্রক্রিয়া, যা প্রতিটি শিশুর চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী শিখন ও জ্ঞান অর্জনের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়। তিনি বলেন, একীভূত শিক্ষা হচ্ছে একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব, ছেলেমেয়ে, প্রতিবন্ধী-অপ্রতিবন্ধীসহ সব শিশুকে একই শিক্ষক দিয়ে, একই পরিবেশে, একসঙ্গে পাঠদান করে। এটি সামাজিক বৈষম্য নিরসনেও চমৎকার কাজ করে।
সরকারি সূত্রে জানা যায়, দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও অটিজম শিশুদের জন্য চালু করা হচ্ছে 'একীভূত শিক্ষা' কার্যক্রম। জেলা পর্যায়ের একটি বাছাই করা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই লেখাপড়া করবে এসব শিশু। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের মাধ্যমে সেখানে পরিচালিত হবে ক্লাস ও অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রম। এটি চালু করতে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাছাই করছে সরকার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় উচ্চমাত্রার প্রতিবন্ধীদের জন্য 'বিশেষায়িত শিক্ষা' কার্যক্রম সীমিত আকারে চালু আছে। দেশব্যাপী 'বিশেষায়িত শিক্ষা'র জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয় করার কার্যক্রম চলছে। মৃদু মাত্রার প্রতিবন্ধী বা বিশেষায়িত শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করা শিক্ষার্থীদের জন্য 'একীভূত শিক্ষা' চালু করা হচ্ছে। এর আগে দেশের আটটি মহানগরের আটটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নিয়ে 'একীভূত শিক্ষা' কার্যক্রম শুরুর পদক্ষেপ নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। এসব বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুরাও শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। পাইলট প্রকল্পের অভিজ্ঞতায় এবার এ কার্যক্রম বিস্তৃত করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মাঝারি মাত্রার প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য 'সমন্বিত শিক্ষা' দিতে কোনো স্কুল বর্তমানে চালু নেই। সমন্বিত শিক্ষার কার্যক্রম চালু করতে হলে কোনো বিদ্যালয়ে আলাদাভাবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিখন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পৃথক শিক্ষক প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে, সব ধরনের প্রতিবন্ধীর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় জাতীয়
পর্যায়ে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। এই নীতিমালার আওতায় সব ধরনের প্রতিবন্ধীর জন্য সমন্বিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা সারাদেশে চালু হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় বিশেষ চাহিদার শিশুদের লেখাপড়ার জন্য একটি করে বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয় করা হচ্ছে। বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা শিশুরা পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে 'একীভূত' শিক্ষার আওতায় লেখাপড়া করবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, 'একীভূত শিক্ষা'র আওতায় নিতে প্রতিটি জেলায় একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাছাই করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাছাই করতে গত ৪ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, একীভূত শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর কাছাকাছি একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাছাই করতে হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) সালমা জাহান বলেন, যেসব শিশু বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে, তারা 'একীভূত শিক্ষা'র আওতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখাপড়া করবে। তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থী আগে থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। মাউশি থেকে বিদ্যালয় বাছাইয়ের পর একীভূত শিক্ষা সংশ্নিষ্ট বিদ্যালয়ে চালু করা হলে আগে থেকে যারা লেখাপড়া করছে, তাদের ওপর বিশেষ নজর রাখা হবে। বিদ্যালয়ের বিদ্যমান শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুদের লেখাপড়া করানো হবে। এরই মধ্যে দেশের অনেক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য শিক্ষকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, সারাদেশে অটিস্টিক শিশুদের জন্য রয়েছে মাত্র ৬২টি স্কুল। এর মধ্যে সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত ৫০টি, কল্যাণী ইনক্লুসিভ স্কুলের সাতটি ও সেনাবাহিনীর 'প্রয়াস' নামে একটি স্কুল। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে রাজধানীসহ সারাদেশেই অটিস্টিক শিশুদের জন্য অনেক স্কুল গড়ে উঠেছে।
এ ছাড়া বর্তমানে ৬৪ জেলায় সরকারি উদ্যোগে একটি করে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, সাতটি শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও পাঁচটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় রয়েছে।
প্রাথমিকে প্রতি উপজেলায় বিশেষায়িত স্কুল :অটিস্টিকসহ দেশের প্রতিবন্ধী সব শিশুর জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে 'বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয়' চালু করতে যাচ্ছে সরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে। স্কুল প্রতিষ্ঠায় এরই মধ্যে 'ম্যাপিং' শুরু হয়েছে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সারাদেশে সার্ভে করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল করা হবে। অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা ও অন্যান্য সহায়তাও প্রয়োজন। সে কারণে চারটি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ স্কুলগুলো পরিচালনা করবে। খুব শিগগির স্কুল স্থাপনসহ অন্যান্য কাজ শুরু হবে।'
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতিবন্ধীদের সঠিক পরিসংখ্যানের জন্য 'ডিজিবল ইনফরমেশন সিস্টেম' নামে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্যভাণ্ডার করা হয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৫৪৩ জন। এর মধ্যে অটিজমে আক্রান্ত রয়েছে ৪৪ হাজার ৬৭৫ জন। শারীরিক প্রতিবন্ধী ছয় লাখ ৯১ হাজার ৪৮৩ জন। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক প্রতিবন্ধী ৫২ হাজার ৮৪৬ জন, শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছয় হাজার ৫১৫ জন, সেরিব্রাল পালসি ৬৯ হাজার ৯৩৪ জন, ডাউন সিনড্রোম তিন হাজার ৫৫ জন এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধী ১২ হাজার ৯১১ জন।
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, চার মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজটি শেষ করতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করবে। প্রতিটি উপজেলা ও জেলায় এ কমিটি গঠন করা হবে। উপজেলা ও জেলা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, স্কুলগুলোর পরিচালনাসহ অন্যান্য বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার মিরপুরে ১৫ তলাবিশিষ্ট একটি মাল্টিপারপাস ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে গার্লস, বয়েজ ও প্যারেন্টস ডরমিটরি রয়েছে। প্রকল্প শেষ হলে সেখানে অটিজম-সংক্রান্ত ও অন্যান্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্য ডরমিটরি, অডিটরিয়াম, ফিজিওথেরাপি সেন্টার, ডে-কেয়ার সেন্টার ও বিশেষ স্কুল থাকবে। আগামী বছরের জুন মাসে এ প্রকল্প শেষ হবে।
'স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম' :২০১১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পাসে একটি সম্পূর্ণ অবৈতনিক স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম করা হয়। পরে মিরপুর, লালবাগ, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে এবং ছয়টি বিভাগীয় শহরে ও গাইবান্ধা জেলায় একটিসহ মোট ১১টি স্কুল চালু করা হয়েছে। এসব স্কুলে মোট ১৪৪ জন অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশু বিনামূল্যে লেখাপড়া করছে। এসব স্কুল পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলায় সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনাও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রয়েছে।
সৌজন্যে: সমকাল