স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্যানেল তৈরি করে স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু হয়। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি শুরু হয় প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমল থেকে। সামরিক শাসনের প্রথমদিকে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান ড. আ. মজিদ খান। ঐ সময়ে পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সংগঠন ছিল বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। এ সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা মহানগরীর শিক্ষকেরা ১৮ দিন ও সারাদেশে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ৩ মাস ১০ দিন ঐক্যবদ্ধভাবে ধর্মঘট করে সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সর্বপ্রথম দাবি মানতে বাধ্য করান। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয় সংসদে আইন পাস করে ঢাকা মহানগরীর প্রাথমিক শিক্ষাকে তৎকালীন ঢাকা পৌরসভা ও সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে স্থানীয় সরকারের নামে গ্রাম সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ৩ লাখ শিক্ষক মহাবিক্ষোভ করে ঢাকা শহর অচল করে দেয়। এর মতো বিক্ষোভ আজও কোনো পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে দেখা যায় নাই। প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে শিক্ষামন্ত্রী ড. আ. মজিদ খান সংগঠনকে দ্বিধা-বিভক্ত করার জন্য অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। তিনি বহু শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে সংগঠনের ঐক্য নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে প্রধান অতিথি করে সম্মেলন করেও সংগঠন দাঁড় করাতে ব্যর্থ হন তিনি। ড. আ. মজিদ খান শিক্ষকের আবেদনের ওপর Yes লিখে স্বাক্ষর করে দিলেই শিক্ষকেরা নিয়োগপত্র পেয়ে যেত। পরবর্তীকালে উপজেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা পেয়ে শুরু হয় প্রাথমিকে অবাধ শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য।
প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি সম্মেলন হয় বর্তমান সচিবালয়ের অপর পাশের বিশাল খালি জায়গায়; রমনা রেলওয়ে ময়দানে। আগের রাত্রে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাঁদা পানিতে ঐক্যবদ্ধভাবে লাখে লাখে শিক্ষক অবস্থান করেছিলেন। সেদিনের সমাবেশ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট এরশাদ বলেন, “আপনাদের নেতা সমাবেশ-মহাসমাবেশ কাকে বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।” সেদিন প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট, পোষ্য কোটাসহ প্রাথমিক শিক্ষকদের অসংখ্য দাবি বাস্তবায়িত হয়।
সে সময় বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদ। তিনি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের পর রাজনীতিতে বিতর্কিত ব্যক্তি হওয়ায় ধীরে ধীরে বিশাল ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মরহুম আযাদ তাঁর বক্তব্যে উপজেলা শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির কথা প্রেসিডেন্ট এরশাদের সমীপে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “একজন ঠিকাদার লাখে লাখে টাকা দুর্নীতি করলেও সাধারণ মানুষের অজানা থাকে। অথচ শিক্ষক নিয়োগের ঘুষের টাকা জোগাড় করতে গ্রামের মানুষ জমি-পশু-গাছ বিক্রি করে। গ্রামের পর গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে যে, অমুকের সন্তান টাকা ঘুষ দিয়ে মাস্টারির চাকরি পেয়েছে।’’
সম্মেলনের পর থেকে উপজেলার কাছ থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা মহাপরিচালক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে নিকট ন্যস্ত হয়। তৎকালীন মহাপরিচালক ড. জহিরুল ইসলাম ভূঞা ও আজিজ আহম্মেদ চৌধুরীর কঠোর ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ আজও অনেকটা দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ অবস্থায় আছে। প্রাথমিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা বদলি বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক জাহানারা বেগমের আমলেও ঘুষের বিনিময়ে হয়েছিল। তবে, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তেমন কোনো ঘটনা শোনা যায়নি। আজও বদলির বিষয়ে ঘুষ দুর্নীতির বিষয়টি প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ায় অভিযোগ পাওয়া যায়। বিষয়টি কঠোর হস্তে জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনা প্রয়োজন।
সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমানের আমলের প্রথমদিকে সুষ্ঠু ও কড়াকড়ি নজরদারির ফলে প্রশ্নফাঁস শূন্যের কোটায় চলে আসছে। বর্তমানে শিক্ষক সংকটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেহাল অবস্থা। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ২০ শতাংশ বদলি কোটা নির্ধারণ আজ গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকের সংকটে প্রাথমিক শিক্ষার অস্তিত্ব বিপন্ন। জানি না, শিক্ষক সংকট দূরীকরণের চেয়ে জরুরি কী কাজে এত ব্যস্ত কর্মকর্তারা? যার জন্য দীর্ঘ মাসের পর মাস প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা পেছানো হলো।
এককথায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় সকল সমস্যা দূরীকরণে সংশ্লিষ্টদের মারাত্মক অবহেলা লক্ষ করা যাচ্ছে। ঢিলেঢালাভাবে চলছে অনেক কাজকর্ম। যা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে চ্যালেঞ্জ। এর একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়। বিধি মোতাবেক চলতি দায়িত্বের ভাতা দেয়ার কথা। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সচিব, মহাপরিচালক বরাবর চলতি দায়িত্বের ভাতা প্রদানে আবেদন করা হয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর আইনি নোটিশও দেওয়া হয়। গত ১৫ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর হতে চলতি দায়িত্বে সরকারি বিধি মোতাবেক ভাতা প্রদানে আদেশ জারি হয়। অথচ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে পদায়নকৃত প্রধান শিক্ষকেরা চলতি দায়িত্বের ভাতা আজও পায় নাই। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কাজ কর্মের গতি দেখলে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে হতাশা ছাড়া কিছুই ভাবা যায় না। গত শুক্রবার (২৪ মে) অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে মূল চক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ঘৃণ্য চক্রকে সমূলে বিনাশ করতে হবে। আগামী প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের ভূমিকার প্রতি তাকিয়ে আছে শিক্ষক, জনগণসহ সুধী সমাজ।
লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা।