প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সংগ্রামের ইতিহাস - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সংগ্রামের ইতিহাস

মো. সিদ্দিকুর রহহমান |

একুশের আর্তনাদ নিয়ে একটি লেখা পত্রিকায় প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। হঠাৎ করেই নিজের মনে প্রশ্ন জাগলো, এই আর্তনাদের জন্য কি শুধু কতিপয় ঘৃণ্য চক্র দায়ী? নতুন প্রজন্মকে দেশ সম্পর্কে জানার জন্য উৎসাহিত করতে কিংবা দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতিকে তাদের সামনে তুলে ধরতে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের কি কোন দায় নেই? আমার সেই লেখা যেন ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবাদের মতো। সে আত্ম উপলব্ধি থেকে আজকের লেখার অবতারণা। বাঙালি জাতির গর্ব মহান একুশ, ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে অর্জিত মহান স্বাধীনতা। এছাড়াও বাঙালি জাতির অসংখ্য গর্বের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপাদান ছড়িয়ে আছে বর্ষপঞ্জিকায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফকির লালন শাহ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ গুণীব্যক্তির জন্ম এই বাংলায়। দেশের ইতিহাস জানার পাশাপাশি এদেশের প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের উচিত তাদের পূর্বসূরীদের ইতিহাস সম্পর্কে জানা। কারণ প্রাথমিক শিক্ষক সমাজেরও আছে অনেক গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস। প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের প্রথম সংগঠনটি গড়ে উঠে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ সিরাজগঞ্জের ইন্টারমিডিয়েট কলেজে নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামে। বর্তমান পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত হয় এ সংগঠনটি।

দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামে বর্তমান বাংলাদেশ অংশের নামকরণ হয়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশের খ্যাতনামা বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ আজিমউদ্দিন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান সংগঠনটির সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। অসংখ্য শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন স্তরে ও পদে দায়িত্ব পালন করেন। সংগঠনটি ১৯৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে ১৮০৮/৭৫ নং রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান মুসলিম লীগ ভাবাদর্শের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ৬৯-এর গণআন্দোলনের পর পরই সারাদেশে ৬ দফা আন্দোলনের ডামাডোল বেজে ওঠে। দেশ দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে। সে আন্দোলনে সকল পেশাজীবীরা অংশগ্রহণ করলেও অনুপস্থিত থাকে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ। বর্তমান ময়মনসিংহ জেলা সমিতির কার্যালয় ছিল তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মূল অফিস। অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো ঢাকা নবাববাড়ির একটি পতিত কক্ষ। সে সময়ের নেতারা ছিলেন ষাটোর্ধ্ব। তরুণ নেতৃত্ব ছিল অতি নগণ্য। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিকে ৬ দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্ত করার লক্ষ্যে এগিয়ে এলেন এক ঝাঁক তরুণ। তাদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদ। নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক আবুল কালাম আযাদসহ মানিকগঞ্জের আশরাফউদ্দিন, আ.কা. ফজলুল হক, আলতাফ হোসেন দাদুসহ অসংখ্য তরুণ প্রাথমিক শিক্ষক নেতা। তাদের নেতৃত্বে সকল পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই নেতৃত্বে মোনায়েম খানের গভর্নর হাউস ঘেরাও করে আদায় করা হয় সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন স্কেল। এই বেতন স্কেল প্রাপ্তির পূর্বে প্রাথমিক শিক্ষকেরা যে সামান্য টাকা পেত, সে টাকা হাটবারে ভেঙে ভেঙে পোস্ট অফিসের পিওনের কৃপায় পেয়ে থাকতো। বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষক অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধকরণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবুল কালাম আযাদের বক্তব্য প্রচার করা হয়। তৎকালীন সময়ে কোন প্রাথমিক শিক্ষক বা তাঁর পরিবারের সদস্য স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল এমন নজির নেই। দেশ স্বাধীন হলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে একই আওয়াজই শুধু চারদিকে নেই আর নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক শূন্য, রাস্তাঘাট, রেলপথ, বাড়িঘর, দোকানপাট ধ্বংসপ্রাপ্ত, লঞ্চ, স্টিমার, উড়োজাহাজসহ অন্ন, বস্ত্র, শিশু খাদ্যের তীব্র সংকট। অভাবের তাড়নায় সারাদেশে হাহাকার। লুটতরাজ, ছিনতাই ছিল সারাদেশের নৈমিত্তিক ঘটনা। এরকম অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, কী করে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলা রূপে গড়ে তোলা যায়। তাঁর ভাবনায় ছিল তৃণমুল মানুষের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হলেই সুখী, সুন্দর, সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাবর অস্থাবর সম্পদসহ ১লা জুলাই’ ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাতীয়করণ করেন। তাঁর মতো আরেকটি দু:সাহসিক কর্ম সম্পাদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সারাবিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর কাজ এগিয়ে নিয়ে ও বিপুল সংখ্যক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে দেশবাসীসহ সমগ্র বিশ্বকে বিস্মিত করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে একটি ঘৃণ্যচক্র প্রাথমিক শিক্ষকদের থানার বাইরে বদলি করার আদেশ জারি করেন। তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদ ও সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল কাশেম ফজলুল হকের মহামান্য সুপ্রিমকোর্টে দায়ের করা রিট আবেদনে সেই আদেশ রহিত হয়। প্রায় দেড় লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকুরি একসাথে জাতীয়করণ হওয়ায় ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সার্ভিস বইয়ের চরম সংকট দেখা দেয়।

সেই সংকট মোকাবেলার লক্ষে সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি সার্ভিস বইয়ের প্রিন্ট করে সংকট দূর করে। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খাতা, পেন্সিল, দুধ, ছাতু বিনামূল্যে দেওয়া হতো। তখনকার দিনে প্রধান শিক্ষকেরা ১০ টাকা দায়িত্ব ভাতা পেতেন। স্কুল কন্টিজেন্সি পাওয়া যেত বছরে ২৪ টাকা। বঙ্গবন্ধুর বিয়োগান্ত ঘটনার পর ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে কন্টিজেন্সি ও প্রধান শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের দাবিতে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের ফলে কন্টিজেন্সি বছরে ৩৬ টাকা, প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ৩০০ টাকা থেকে ৩২৫ টাকা করা হয়। তৎকালীন সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের ঐক্য ও সংগ্রামী চেতনা বিনষ্ট করার লক্ষ্যে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রথমে ঢাকা মহানগরীর শিক্ষকদের ঢাকা পৌরসভা এবং ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে সারাদেশের শিক্ষকদের গ্রাম সরকারের অধীনে ন্যস্ত করেন। অক্টোবর মাস থেকে প্রায় ১ মাস ঢাকা শহরের এ.বি.এম চান মিয়া ও আ. আউয়াল তালুকদারের উদ্যোগে কমলাপুর ও বি.জি. প্রেস প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ছিল। প্রাথমিক শিক্ষকদের স্বার্থের পরিপন্থি কাজ করে আ. আউয়াল তালুকদার তৎকালীন বি.এন.পি সরকারের দৃষ্টি কেড়ে নেন। অবশেষে দীর্ঘ ৩ মাস ৬ দিন বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখে। আন্দোলনের বিরোধিতা ও সরকারের সান্নিধ্যে যাওয়ার ফলে তৎকালীন বি.এন.পি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যক্ষ ইউনুস খানের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সর্ববৃহৎ আন্দোলন ৮১ সালের মহাবিক্ষোভ ও ৩ মাসের অধিক সময়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের এক নাগাড়ে ধর্মঘট। সে দিনের মহাবিক্ষেভে ঢাকা শহর ছিল অবরুদ্ধ। সেদিন প্রত্যেক প্রাথমিক শিক্ষক তাদের একজন পরিবারের সাথী নিয়ে প্রায় ৩ লক্ষ লোকের বিক্ষোভ সমাবেশ সৃষ্টি করেছিল। ক্ষমতাসীন সরকার শিক্ষকদের ওয়াসার পানি ক্রয় করার অনুমতি দেননি।

ক্ষমতাসীন বি.এন.পি’র সামরিক সরকারকে পরাভূত করার প্রথম আন্দোলনই প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন। আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল বায়তুল মোকাররমের মঞ্চে একসাথে বসে প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনে ১০ মার্চ’১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে হরতালের ঘোষণা দেন। সারাদেশে শিক্ষকদের নিয়ে সকল রাজনৈতিক দল হরতালের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। সে সময় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন। তখন তার পক্ষে মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ১১ সদস্যের সাথে আলাপ আলোচনা করে জাতীয় সংসদে পাস করা ঢাকা মহানগরী প্রাথমিক শিক্ষকদের ঢাকা পৌরসভায় ন্যস্তকরণ বিল ও সারা দেশকে প্রাম সরকারের অধীনে ন্যস্তকরণ অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এ বিশাল আন্দোলনে তৎকালীন সরকার তাদের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ধর্মঘটের মাঝে ২দিন মহাবিক্ষোভে শিক্ষকেরা ঢাকা শহর অচল করার পরও যখন সরকার অনমনীয়, তখন মহাবিক্ষোভ থেকে কর্মসূচি আসল প্রতি উপজেলায় ৫ জন শিক্ষক কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আমরণ অনশন করবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের মহা অনশন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনে সকল রাস্তায় ছড়িয়ে যায়। এত বড় অনশন কর্মসূচি ইতিপূর্বে কিংবা পরে আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে জানা নেই। সেদিনের অনশন কর্মসূচির এক স্মৃতি বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক অর্থ সম্পাদকের আ.ফ.ম. তোহা পাটোয়ারীর শারীরিক অবস্থার অবনতিতে তাকে গভীর রাতে ফিডার ভর্তি দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। উক্ত অনশন কর্মসূচি ৩ দিন চলে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ ৮১ সালের আন্দোলনে প্রাথমিক শিক্ষকদের পাশে থেকে সাহায্য সহযোগিতা করে শিক্ষক সমিতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে। ক্ষমতাসীন বি.এন.পি’র সামরিক সরকারকে পরাভূত করার প্রথম আন্দোলনই প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন। শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠন ভাঙার চক্রান্ত। পরবর্তীতে ওসমানী উদ্যানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে প্রধান অতিথি করে ঢাকা ওসমানী উদ্যানে ও পরবর্তীতে পাবনায় পাকশিতে বিশাল শিক্ষক মহাসমাবেশের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকদের অনেক সমস্যার ও দাবি আদায়ে বাধ্য করা  হয়। মহাসমাবেশের আগের দিন রাত ৯ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় ওসমানী উদ্যানে কাদা পানিতে একাকার হয়ে যায়। সে কাঁদা পানিতে বসে লক্ষাধিক প্রাথমিক শিক্ষক মহাসমাবেশে অবস্থান করছিলেন। সে মহাসমাবেশে রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন, “মহাসমাবেশ কাকে বলে আপনাদের নেতা অধ্যাপক আযাদ আমাকে  চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন”। সে মহাসাবেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কল্যাণ ট্রাস্ট, শিক্ষকদের পোষ্য কোটা, উপজেলা পরিষদে শিক্ষক নিয়াগ, শাস্তি ও পদোন্নতি রহিত করা, সি.ইন.এড প্রশিক্ষণ ২ বছরের স্থলে ১ বছর নির্ধারণসহ শিক্ষকদের বহু সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল। পাকশির মহাসমাবেশ হয়েছিল পাবনার পাকশি ব্রিজ সংলগ্ন বিশাল ময়দানে। সেখানেও বৃষ্টি বাদলের মাঝে লক্ষাধিক শিক্ষক জমায়েত হয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষকের পদসৃষ্টি, এইচ.এস.সি ডিগ্রি পাস শিক্ষকদের ওভারড্রন থেকে অব্যহতিসহ স্কেল পরিবর্তন, শিক্ষকদের স্বল্প সুদে  গৃহ নির্মাণ ঋণ দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করা হয় । সরকার পরিবর্তনের কারণে আশ্বাস সমূহ বাস্তবে কার্যকর করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

এরশাদ সরকারের পরে সরকারি কর্মচারিদের ঈদ, পূজা-পার্বনে অর্ধেক বেতন অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হতো। তাও ফেরৎযোগ্য শর্তে। দুই ঈদে পুর্নবেতন বোনাস হিসেবে অফেরৎযোগ্য হিসেবে ও সরকারি কর্মচারিদের জন্য ৮-১২-১৫ বছর পর পর তিনটি টাইম স্কেল আদায় সম্ভব হয়েছে এরশাদের আমলে। এক কথায় বলতে গেলে রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে সর্বস্তরের শিক্ষক কর্মচারিদের কাঙ্খিত দাবি দাওয়া পূরণ হয়েছে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ২০৫ খাতের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রকল্পের মেয়াদ সমাপ্তিতে তাদের চাকুরিচ্যুতির ঘোষণা দিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার। এবারেও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ঢাকা শহরে মহাবিক্ষোভের ডাক দেন। আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার পরের দিন অধ্যাপক আযাদকে গ্রেফতার করা হয়। কর্মসূচিতে ঢাকায় শিক্ষকদের আসার ওপর চলে কঠোর চাকুরিচ্যুীতর হুঁশিয়ারি। শিক্ষকদের ভাড়া করা বাস, লঞ্চসহ যানবাহনের ওপরও বাধা আসে। স্কুলে স্কুলে পৌছে দেয়া হয় সমাবেশে যোগদান করলে চাকরিচ্যুতির হুশিয়ারির টেলিগ্রাম। সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল কাশেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে দৈনিক বাংলা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত রাস্তা প্রাথমিক শিক্ষকদের দখলে চলে যায়। আন্দোলনের গতি পুনরায় ৮১ সালের মতো উত্তাল হবে ভেবে তৎকালীন সরকার ২০৫ এর খাতের শিক্ষকদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করেন এবং পরের দিনই অধ্যাপক আযাদকে মুক্তি দেন। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য আন্দোলনে মুক্তাংগনের অনশন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাঙ্খিত দাবি পূরণ সম্ভব হয়নি। প্রধান শিক্ষক সহকারিদের একটা স্কেল পরিবর্তন হলেও শিক্ষকদের বেতন কমে শুভঙ্করের ফাঁকির মতো হয়। পূর্বের মতো প্রাথমিক শিক্ষার ঘৃণ্য শত্রুরা বি.এন.পি সরকারের অভ্যন্তরে থেকে শিক্ষকদের আশা আকাঙ্খাকে নস্যাৎ করে দেয়। সে আন্দোলনে আমাকে ও লালবাগ থানার শিক্ষক সেলিমুজ্জামানকে জেল হাজতে যেতে হয়েছে। অধ্যাপক আযাদের নেতৃত্ব অবসানের পর কাউন্সিলের মাধ্যমে আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

বিগত সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও শিক্ষা এনজিওর মালিক রাশেদা কে চৌধুরীর সময়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্র্যাকের অধীনে ন্যস্ত করার ষড়যন্ত্র শিক্ষকদের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা হয়। সে সময় সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের কোটি কোটি টাকা শিক্ষকদের সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসাসহ নানা সংকটে সহযোগিতা করা হয়। কল্যাণ ট্রাস্টের কাজ গতিশীল করার জন্য একজন শিক্ষককে উপজেলা প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়া হয়। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব শেষ হওয়ার পূর্ব লগ্নে সভাপতি নুরুল আবছার, ওয়াহিদুজ্জামান মিয়া, বি.এম. আসাদউল্লা বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বিলুপ্ত ঘোষণা করে আ. আউয়াল তালুকদারের নেতৃত্বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। আমি, সুবল চন্দ্র পাল, আশরাফ উদ্দিন মোল্লা সকালের খবর পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সমিতি পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যাই। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউটে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলের মাধ্যমে আ. বাসারকে সভাপতি ও আনোয়ারুল ইসলাম তোতাকে সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব অর্পন করা হয়। বর্তমান নেতৃত্ব আন্দোলন করে সহকারী প্রধান শিক্ষকদের মাঝে বৈষম্যের দেয়াল সৃষ্টি করে এক স্কেল আপগ্রেড করার দাবি আদায় ও প্রধান শিক্ষকদের ৬৪০০ টাকা স্কেলে ২য় শ্রেণি মর্যাদা আদায় করতে সফল হয়েছে। নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতায় সহকারি/প্রধান শিক্ষকদের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে।

তদুপরি বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ঐতিহ্য ও ঐক্য মোটেই বিঘ্নিত হয়নি। আ. আউয়াল তালুকদারসহ কোন কোন নেতা শিক্ষকদের কল্যাণের পরিবর্তে অবৈধ অর্থ উপার্জনকে মুখ্য কাজ হিসেবে করতে দেখা গেছে। সবশেষে মেয়াদ উত্তীর্ণের অনেক পরে মোয়াজ্জেম হোসেন মানিকের নেতৃত্বে গঠন করা হয় বাংলাদেশ প্রাথামিক শিক্ষক সমিতির নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে আবার সাময়িক হোঁচট খেল বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। শিক্ষকদের কাল্যাণে আবার ৮১ এর কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হোক প্রাথমিক শিক্ষকদের মাঝে। নেতৃত্বের চেয়ে বড় সমস্যা সমন্বয় সাধন। প্রাথমিক শিক্ষকদের সহযোগিতায় সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আগামি দিনের শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাব এ অঙ্গিকার আমি করছি। জাতীয় দিবসগুলো কর্মদিন ঘোষণা করে উক্ত ৬ দিন ছুটি গ্রীষ্মের ছুটি সঙ্গে যোগ করা। প্রাথমিক শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ভাতা সরকারি কর্মচারীদের মত ৩ বৎসর অন্তর প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। প্রধান শিক্ষদের সংরক্ষিত ছুটি পূর্বের মত বহাল রাখার দাবিতে  ২৩ শে মার্চ ২০১৭ আধঘন্টা কর্মবিরতি পালন করে সকল সংগঠন শিক্ষকদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হবেন এ প্রত্যাশা।

মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053031444549561