প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রান্তিক যোগ্যতা - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রান্তিক যোগ্যতা

আল ফয়সাল বিন কাশেম কানন |

একটি প্রবাদ আছে, শিক্ষার্থীকে তোমরা (শিক্ষকেরা) কেবল তোমাদের শিক্ষাতেই বেঁধে ফেল না; মনে রেখ, তারা তোমাদের সময়ে নয়, তাদের সময়ে জন্মেছে। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে শিক্ষার্থীকে খাপ খাওয়ানোর এই প্রচেষ্টা বোধ করি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণ মিলেছে এ স্তরে অর্জিত জ্ঞান সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ফলপ্রসূ প্রভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনে। বিশেষত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশই অষ্টম শ্রেণির আগে ঝরে পড়ে, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করা অনস্বীকার্য। কাজেই এই স্তরের শিক্ষার কাঠামো কেমন হওয়া উচিত, এই উদ্দেশ্য কী হবে, পাঠ্যক্রম কি উপাদান ধারণ করবে ইত্যাদি বিষয়গুলো বাড়তি নজরের দাবি রাখে।

সৌভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশ সরকারও অনুভব করে, এমনভাবে প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামোকে সাজানো উচিত, যাতে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমেই জীবনের অবশ্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পারে। এটাও মাথায় রাখা হয়, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা যেন নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ধারণা পায়। এ অনুভবের প্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় আলাদা প্রাথমিক অধিদপ্তর স্থাপন, ১৮৩৪টি সহকারী থানা পরিষদের উপর প্রাথমিক শিক্ষার দায়-দায়িত্ব ন্যস্তকরণ, শিক্ষকদের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ প্রদান, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারিকরণ ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু এসব পদক্ষেপ প্রহণের পরেও এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি।

এখানে যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে, সেটি হলো, শিক্ষাকে শুধু বর্তমানের চাহিদা মেটানোর জন্য নয়, বরং ভবিষ্যত্ জীবনে তাকে সক্ষম করার ব্যাপারটিতেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আর এ সামর্থ্য অর্জন নিশ্চিত করার জন্য অনাবশ্যক তত্ত্ব ও তথ্য শেখার পরিবর্তে একান্ত আবশ্যকীয় যোগ্যতা অর্জনের দিকটি অধিক মনোযোগ দাবি রাখে। সামর্থ্য অর্জনের এই দক্ষতা যেগুলো প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শিশু অর্জন করবে বলে ধরে নেওয়া হয়, সেগুলোই প্রাথমিক শিক্ষার প্রান্তিক যোগ্যতা।

এই প্রান্তিক যোগ্যতা নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় (১৯৮৫-৯০) জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড কর্তৃক প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম নবায়ন ও পরিমার্জনের একটি বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ করে। এই কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষক প্রশিক্ষক,  বিষয় বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে সংশোধন ও পরিমার্জনের ভিত্তিতে প্রাথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিখনক্রম প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়। সেখানে ১৯টি উদ্দেশ্য ও ৫৩টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করার পাশাপাশি প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো সুনির্দিষ্ট করা, শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতাসমূহ চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে ২০০০ সালে প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো পরিমার্জন করে ৫০টি করা হয়। দুঃখের বিষয় এই যে, তারপর এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও প্রাথমিক স্তর শেষে শিক্ষার্থীদের যতটুকু প্রান্তিক দক্ষতা অর্জন করা উচিত,  তার বেশকিছু তারা এখনো অর্জন করতে পারছে না।

এডুকেশন ওয়াচ (২০০০)-এর গবেষণা রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, কাগজে-কলমে পরিমাপযোগ্য ২৭টি যোগ্যতার (যদিও মোট যোগ্যতা ৫৩টি) মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ শিশু সবকয়টি দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। এর আরো ১৫ বছর পর এডুকেশন ওয়াচ (২০১৫)-এ দেখা যায়,  মাত্র ১.৬ (এক দশমিক ছয়) শতাংশ শিক্ষার্থী সবকয়টি দক্ষতা অর্জন করতে পারছে। যা দেখে বোঝা যায়, এই ১৫ বছরে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। এছাড়া দেখা যাচ্ছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থীর দক্ষতা ১৮ এর নিচে; যা নিশ্চিতভাবে চিন্তার উদ্রেক করে। এ পরিস্থিতিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে সঠিকভাবে ও যুক্তি সহকারে পর্যালোচনা করাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে যে দিকগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে আছে: শিক্ষকদের উদাসীনতা, পিতা-মাতার শিক্ষার অভাব, পর্যাপ্ত খাদ্য নিরাপত্তা না থাকা, শ্রেণিকক্ষে ধারণক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থী, আবাস থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দূরত্ব, শিক্ষাক্রমে পর্যাপ্ত আনন্দের অভাব ইত্যাদি যেগুলোকে প্রয়োজনীয় নিরীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। 

এমতাবস্থায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যাশা, তারা জাতির উন্নতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এই দিকটির উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশকে একটি সক্ষম, সামর্থ্যবান রাষ্ট্রে পরিণত করার ভিত্তিটিকে মজবুত করবেন।

লেখক:শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035769939422607