প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সৃজনশীল হচ্ছে - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সৃজনশীল হচ্ছে

মাছুম বিল্লাহ |

জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আদেশ জারি করেছে যে ‘২০১৮ খ্রিস্টাব্দের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর বিভাজন জাতীয় কর্মশালার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বিষয়ে শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন করা হবে।’ এর অর্থ হচ্ছে  চলতি বছরের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার শতভাগ প্রশ্ন হবে যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল। এই সংবাদ কি কোনো ধরনের উষ্ণতা বা উত্তাপ বা এক্সাইটমেন্ট ছড়ায়? ছড়ায় না। এর কারণ অনেক।

প্রথমত, শিক্ষকসমাজ প্রাথমিক পরীক্ষার পক্ষেই না। তারা বরং পরীক্ষাটি বাদ দেওয়ার জন্য বারবার বলে আসছে। দ্বিতীয়ত, পাবলিক পরীক্ষা তার উপযোগিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বহু আগেই। পরীক্ষা শুধু পরীক্ষার জন্যই হচ্ছে, এতে মান যাচাই বা মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। তৃতীয়ত, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তো সব জায়গায় পত্রিকার মতো বিক্রি হচ্ছে, এমনি পাওয়া যাচ্ছে আর ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ক্লিক করলেই পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই পরীক্ষার প্রশ্ন ক্রিয়েটিভ হোক বা তার চেয়েও বড় কিছু হোক—এ নিয়ে কারোরই কোনো আগ্রহ নেই। চতুর্থত, ক্রিয়েটিভ প্রশ্ন কে বা কারা তৈরি করবেন? মাধ্যমিকে ক্রিয়েটিভ প্রশ্নের ওপর অনেক প্রশিক্ষণ(?) হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭০-৭৫ শতাংশ শিক্ষক প্রকৃত সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকরা প্রায় সবই সরকারি চাকরি করেন। তাঁরা কেন কষ্ট করতে যাবেন ক্রিয়েটিভের জন্য? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী স্বয়ং গত ৩ ফেব্রুয়ারি একটি সরকারি বিদ্যালয়ে দেখে এসেছেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা টু, থ্রি ও ফোর বানান বলতেও পারেনি, লিখতেও পারেনি। এই অবস্থায় কিসের সৃজনশীল প্রশ্ন আর কিসের কী? প্রয়োজন এই বাস্তবতার নিরিখে ব্যবস্থা নেওয়া। সেটি শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে।

সৃজনশীলতা হচ্ছে নতুন কিছু তৈরি করার সামর্থ্য, কোনো সমস্যার সমাধান অথবা নতুন শৈল্পিক গঠন বা কাঠামো।

কিন্তু আমরা যে সৃজনশীলতা চালু করেছি তা ব্লুম ট্যাক্সামনির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে প্রথম স্তরটি হচ্ছে মুখস্থ করা। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থী তার অর্জিত জ্ঞান থেকে কী শিখেছে, তা বুঝতে পারবে। জ্ঞানস্তর হচ্ছে চিন্তন দক্ষতার সর্বনিম্ন স্তর। এর অর্থ হচ্ছে আগের জানা কোনো কিছু স্মরণ করা। এর মধ্যে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত সেগুলো হচ্ছে—সাধারণ শব্দ, বিশেষ তথ্য, তত্ত্ব পদ্ধতি, প্রক্রিয়া, ধারণা এবং নীতিমালা স্মরণ করা বা চিনতে পারা। জ্ঞানস্তরের প্রশ্নের উত্তর সরাসরি পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায়। যেমন কারোর জন্ম তারিখ বলতে পারা। অনুধাবন স্তর। এটি হচ্ছে কোনো বিষয়ের অর্থ বোঝার দক্ষতা। এটি হতে পারে তথ্য, নীতিমালা, সূত্র, নিয়ম, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ইত্যাদি বুঝতে পারা। বুঝতে পারলেই ব্যাখ্যা করা অথবা অনুবাদ করা, মৌখিকভাবে এবং প্রতীক, গ্রাফ, সারণি ও চিত্রের সাহায্যে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা সম্ভব হয়। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য জ্ঞানস্তরের তুলনায় অধিকতর দক্ষতা প্রয়োজন।

সৃজনশীল প্রশ্নের প্রথম অংশটি জ্ঞানস্তরের বা সহজ বা নিতান্তই স্মৃতিনির্ভর। প্রশ্নটি স্মৃতিনির্ভর হলেও তা যেন অর্থবহ এবং শিক্ষণীয় হয়। এজাতীয় প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে অনুধাবন স্তরের প্রশ্ন। এর মাধ্যমে শিক্ষাক্রমের আওতায় পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তু অনুধাবন করার ক্ষমতা যাচাই করা হয়। পাঠ্য বইয়ের বিভিন্ন ঘটনা বা বিষয়বস্তুর বিবরণ দেওয়া থাকে। এ ধরনের প্রশ্নে সরাসরি পাঠ্য বইয়ের অনুরূপ বিবরণ জানতে চাওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিজের ভাষায় ব্যাখ্যা বা বর্ণনা দিতে বলা হয়। প্রশ্নের তৃতীয় অংশটি হচ্ছে প্রয়োগ স্তরের প্রশ্ন। সৃজনশীল প্রশ্নের এ অংশ ভালো মানের উদ্দীপকের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ উদ্দীপক যদি খুব মানসম্পন্ন হয়, তবে প্রয়োগ দক্ষতার প্রশ্নটি প্রণয়ন করা সম্ভব। এই প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠ্যপুস্তকে থাকবে। পাঠ্যপুস্তকের তথ্য এবং এর অনুধাবন উদ্দীপকে বর্ণিত নতুন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী প্রয়োগ করবে। পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থী ভালোভাবে পড়লে সে বিষয়ে তার স্পষ্ট ধারণা হবে, সেটি নতুন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর প্রয়োগ করার ক্ষমতাই প্রয়োগ দক্ষতা। সৃজনশীল প্রশ্নের চতুর্থ অংশ হচ্ছে উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন। এ স্তরের প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিচার-বিবেচনা করার দক্ষতা, কোনো বিষয় বা ঘটনা বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা ইত্যাদি যাচাই করা হয়। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠ্যপুস্তকে থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য নতুন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করে শিক্ষার্থী তার বিচার-বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মূল্যায়ন দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ পাবে।

পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করার জন্য এখনো শিক্ষকদের নির্ভর করতে হয় নোট ও গাইডের ওপর। সেখানে যেভাবে প্রশ্ন দেওয়া থাকে, শিক্ষকরা সেভাবেই কিংবা সামান্য একটু পরিবর্তন করে তুলে দেন। এই অভ্যাসের ফলে অনেক শিক্ষকের প্রশ্ন তৈরি করার দক্ষতাই চলে গেছে। এই যখন সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা তখন এই সংবাদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে খুব একটা আগ্রহের সৃষ্টি করবে না বা করে না। প্রশ্নে দেখা যায় গত্বাঁধা কিছু উদ্দীপক থাকে। ওই উদ্দীপক কোনো শিক্ষক তৈরি করেন না, নোট ও গাইড থেকে নিয়ে করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের না হয় সৃজনশীলতার বিকাশ, না পায় নিজ থেকে কিছু লেখার কোনো আনন্দ। এরপর আবার সব প্রশ্নই ফাঁস, প্রশ্ন ঘোরে আকাশে-বাতাসে। এ প্রশ্নগুলোই যদি একজন পঞ্চম শ্রেণির (প্রাথমিক) শিক্ষার্থীকে লিখতে দেওয়া হয়, সে তার মতো লিখবে, মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থীকে লিখতে দিলে সে আরেক ধরনের লিখবে। উচ্চ মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থী তার মতো করে লিখবে, যার মাধ্যমে তার স্বকীয়তা প্রকাশ পাবে। একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন কিছু পড়ে, শুনে, দেখে ও ধারণা নিয়ে উত্তরগুলো নিজের মতো করে লিখবে। এভাবে তার সৃজনশীলতা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে, সেও নিজে লেখার আনন্দ পাবে।

এখন আমরা যে সৃজনশীলতার কথা বলছি, তা হচ্ছে গাইডনির্ভর এবং এক ধরনের কাঠামোর মধ্যে ফেলে দেওয়া, এর বাইরে আর যাওয়া যাবে না। তাহলে প্রশ্ন সৃজনশীল হলো কোথায়?

লেখক: মাছুম বিল্লাহ, লেখক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073778629302979