প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে আলাদা শিক্ষা বোর্ড কতটা জরুরি? - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে আলাদা শিক্ষা বোর্ড কতটা জরুরি?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আদলে গঠিত হতে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড। আমরা দেখতে পাই যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের পক্ষে কমবেশি ৩০ লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। রোববার (৯ ডিসেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, তবে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড একটি হবে না, তারও বেশি- সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।

সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরই এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করতে আরও এক বছর লাগতে পারে। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২২ লাখ শিশু।

২০১০ সাল থেকে এ পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাদ্রাসার শিশু শিক্ষার্থীদের ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। এবার প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী এই প্রাথমিকে।

তবে দেশের সবচেয়ে বড় এ পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্য কোনো শিক্ষা বোর্ড নেই। অবশ্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১০ বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড নামে পৃথক একটি শিক্ষা বোর্ড গঠনের কথা বলে আসছে; কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি এখনও।

বোর্ড গঠনের প্রধান অন্তরায় নাকি অর্থনৈতিক- এ দাবি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতির। একটি বোর্ড গঠন করার জন্য জনবল নিয়োগ ও অফিস ব্যবস্থাপনায় অনেক অর্থের প্রয়োজন, যা এ মন্ত্রণালয়ের নেই।

সম্ভাব্য ব্যয় ও জনবল কাঠামোর খসড়া তৈরির জন্য জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে দায়িত্ব দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ভয়, শঙ্কা, মানসিক দুর্বলতা ও অজানা আতঙ্ক নিয়ে শিশুরা এ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়।

তাই, শিক্ষাবিদরা এ পরীক্ষার বিপক্ষে। আমি নিজেও চাই না, শিশুদের জন্য এ ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি। কিন্তু সরকারের নিজস্ব কিছু যুক্তি আছে এবং বাণিজ্যিক কিছু কারণে সম্ভবত পরীক্ষাটি ১০ বছর ধরে চলছে। এত বড় একটি আয়োজন শিক্ষা বোর্ডের মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ছাড়া পরিচালনা করা হচ্ছে; এটি এ পরীক্ষার আরও একটি দুর্বল দিক।

প্রতি বছর এসএসসি কিংবা এইচএসসি স্তরে ১০ থেকে ১৩ লাখ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ পরীক্ষা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৯টি শিক্ষা বোর্ড আছে। এ ছাড়া মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য রয়েছে আলাদা আরও দুটো বোর্ড।

প্রাথমিক পরীক্ষায় সারা দেশে এ দুটি পরীক্ষার প্রায় তিনগুণ শিক্ষার্থী অংশ নেয়; অথচ নেই আলাদা কোনো শিক্ষা বোর্ড। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে।

এ পর্যায়ে কোনো আলাদা বোর্ড না থাকায় সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রদানসহ পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট সব ধরনের কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। প্রতি বছরের শেষ দুটি মাস শিক্ষা কর্মকর্তারা বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ ও প্রতিটি বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার টার্গেট অনুযায়ী ভর্তি কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকেন। একই সময় এ পরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করতে তাদের হিমশিম খেতে হয় ।

প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিধি দিন দিন বাড়ছে। অধিদফতর ও পরিদফতরের মাধ্যমে এ দুটি পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং পাঠ্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব অধিদফতর ও পরিদফতরের।

পাঠ্যক্রম তৈরি, পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ বিতরণ তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের বিষয়টিতে জোর দেয়া হয়েছে।

প্রাথমিক স্তরের সবচেয়ে বড় এ পাবলিক পরীক্ষার ফল তৈরিতেও গত কয়েক বছর অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার উত্তরপত্র সংশ্লিষ্ট জেলায় পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ফলাফলের তালিকা তৈরি হয় উপজেলা শিক্ষা অফিসে।

তবে বৃত্তি পাওয়ার আশায় ভালো ফলের জন্য উত্তরপত্রে নম্বর বেশি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে গত দুই বছর পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর।

নিজের প্রতিষ্ঠানে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পাইয়ে দিতে প্রধান শিক্ষকদের অনেকে মরিয়া হয়ে ঘুষও দিয়ে থাকেন। এ কী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে শিশুদের শিক্ষার ঊষালগ্নে! এ কারণে এক উপজেলার খাতা অন্য উপজেলায় মূল্যায়ন করা শুরু হয়েছে। এটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ বলতে হবে।

প্রথম দুই বছর বিভাগভিত্তিক ফল দেয়া হলেও ২০১১ সাল থেকে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সমাপনীর ফল দেয়া হচ্ছে। আগে এ পরীক্ষার সময় দুই ঘণ্টা থাকলেও ২০১৩ সাল থেকে পরীক্ষার সময় আধা ঘণ্টা বাড়িয়ে আড়াই ঘণ্টা করা হয়।

প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ২০১৭ সাল থেকে দেশের ৬৪ জেলাকে বিশেষ আটটি অঞ্চলে ভাগ করে আট সেট প্রশ্ন ছাপিয়ে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী নিচ্ছে সরকার। ২০১৭ সালে সবক’টি বিষয়ের বহু নির্বাচনী প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় ২০১৮-এর সমাপনীতে তা বাদ দেয়া হয়েছে।

ফলে পরীক্ষার্থীদের ছয়টি বিষয়ের প্রতিটিতে ১০০ নম্বর করে ৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে। প্রশ্নপত্রের নিরপাত্তায় শিক্ষা বোর্ডগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়েছিল। ফলে এবার প্রশ্নেপত্রের নিরাপত্তায় বিশেষ জোর দেয়া হয়। দেশের অভ্যন্তরে দুর্গম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ২০৪টি কেন্দ্রে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছিল।

২০০৯ সালে দেশের মোট শিশুর অর্ধেকাংশ বিদ্যালয়ে আসত না বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। এছাড়া যারা ভর্তি হতো, তাদের ৪৮ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি শেষ না করেই ঝরে পড়ত। তাদের স্কুলে নিয়ে আসা এবং ধরে রাখাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

এখন প্রতি বছরই শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে, ঝরে পড়া কমছে। অবশ্যই আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করে সব ছেলেমেয়েকে গড়ে তোলা।

গত বছর থেকে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় নতুন উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে ভুয়া পরীক্ষার্থী। এ ভুয়া পরীক্ষার্থীরা কয়েক ধাপ উঁচু ক্লাসের শিক্ষার্থী।

মূল পরীক্ষার্থীদের নামে পরীক্ষায় বসা এ অপকর্মকারীর সংখ্যা পিইসির চেয়ে ইবতেদায়িতে ছিল বেশি। প্রতি বছরই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থাকছে। এর অনেক কারণও আছে। গ্রাম আর শহরে পড়াশোনার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।

একটা অসম শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে শিশুরা বেড়ে উঠছে। এরকম একটা পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে শিশুরা ভয় পায়। প্রতি বছরই পরীক্ষার আগে অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে।

এ কারণেও অনেকে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘পিইসি পরীক্ষা আমার কাছে খুবই অপ্রয়োজনীয় একটি পরীক্ষা মনে হয়। শিশুদের কাছে এটা একটা বোঝার মতো। এ পরীক্ষা নিয়ে কার স্বার্থ যে রক্ষা হচ্ছে, কে জানে। তবে একমাত্র নোটবুক আর টিউশন বাণিজ্য যারা করছে, তাদের ছাড়া কারও স্বার্থরক্ষা হওয়ার কথা নয়।

শিশুরা তোতা পাখির মতো পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে বসছে। এ ধরনের পরীক্ষার কোনো অর্থ নেই। আদর্শিকভাবে আমি এ পরীক্ষার ঘোরবিরোধী।’

তবে এ পরীক্ষা চলুক আর না চলুক, এত বড় বিশাল বহরের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ শিক্ষা বোর্ড থাকা প্রয়োজন। শিশুদের জন্য সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের পরিবর্তে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট চালু করা প্রয়োজন।

মূল্যায়ন যেভাবেই করা হোক না কেন, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে প্রয়োজন একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান- যাকে আমরা শিক্ষা বোর্ড বা অন্য যা কিছুই বলি না কেন।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকের কোমলমতি শিশুদের প্রচলিত পদ্ধতির সমাপনী পরীক্ষা তুলে দেয়ার জন্য বারবার বলছেন। সরকার তুলে দেয়ার চিন্তাভাবনাও করেছিল; কিন্তু এবার আবার বলা হচ্ছে, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা থাকবে এবং তা পরিচালিত হবে প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে।

তবে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন- যেখানে গবেষণা বিভাগ, মূল্যায়ন বিভাগ, শিশুবিজ্ঞান বিভাগ নামে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিভাগ থাকবে, যেগুলো শিক্ষার্থীদের আনন্দদানের মাধ্যমে শিক্ষাদান ও অবিরত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ও শিশুকে ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ।

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.008059024810791