একটি দেশের উন্নতির জন্য গুণগত এবং জীবনভিত্তিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। মানবজীবনের চক্রে পরিবার থেকে যে সামাজিক, ধর্মীয় এবং মূল্যবোধের শিক্ষার শুরু হয়, তার একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি হয় প্রাথমিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে। শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন করাই প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। কোমলমতি শিশুর মধ্যে দেশাত্মবোধ, বিজ্ঞানমনস্ক, সৃজনশীল ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে সব শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ একান্ত অপরিহার্য। শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ বাংলাদেশের একটি পিছিয়ে পড়া জনপদ। সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির জলাভূমিঘেরা এ জেলায় রয়েছে অসংখ্য খালবিল, নদীনালা। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো ‘শিক্ষাসহায়তা কর্মসূচি’। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসন, সুনামগঞ্জ প্রাথমিক শিক্ষাকে সুনামগঞ্জের প্রান্তিক হাওরবাসী শিশুকে দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তি, উপস্থিতি ও প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপনের হার উল্লেযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হাওরপাড়ের অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের মৌলিক শিক্ষা হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেছে নিয়েছেন। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
শুধু তাই নয়, অধুনা তারা সন্তানের ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য সচেষ্ট হচ্ছেন। আর এ কারণেই এ জেলায় ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির হার ৯৮ দশমিক ৫৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হারও পূর্বের তুলনায় বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে তারা বিদ্যালয়গুলোতে শিখনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছেন। শিশুর প্রতি এসব শিক্ষকের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় শিশুরা বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, বিদ্যালয়ে শিশুর উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপনের হার বেড়েছে। আর এসব কারণে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানের সুশিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকেই বেছে নিয়েছেন।
পূর্বে ঝরে পড়া প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক সমস্যা ছিল। বর্তমানে এ অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলায় বর্তমানে ঝরে পড়ার হার ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত সব শিক্ষার্থীর পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপন আমরা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছি। আর এরই অংশ হিসেবে শিশুর ঝরে পড়া রোধে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বিদ্যালয়সমূহ দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করার প্রক্রিয়া হাতে নেওয়া হয়েছে। অসচ্ছল পরিবারের শিশুকে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এটি ঝরে পড়া রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া স্থানীয় সহযোগিতায় মিড-ডে মিল চালু, হোম ভিজিট, উঠোন বৈঠক, মা সমাবেশ ইত্যাদি কার্যক্রমসহ নানাবিধ সমাজ উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম জোরদার করার মাধ্যমে অভিভাবকগণকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। এতে অভিভাবকগণ প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপনের সুফলসমূহ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং শিশুকে নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাস্তর বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার একটি গুরত্বপূর্ণ স্তর। শিশুর মধ্যে বিদ্যালয়ভীতি দূরীকরণ, শিক্ষা পরিবেশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভিযোজিত করে তোলাই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ স্তরের শিশুরা যাতে খেলার ছলে শিক্ষা লাভ করতে পারে সে জন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির প্রবর্তন। বিদ্যালয় পরিবেশের সঙ্গে কোমলমতি শিশুর পরিচয় ঘটানো, খেলার মাধ্যমে পড়াশোনা, শিশুর ইতিবাচক মন ও মনন গঠনের কাজটি সুন্দরভাবে চলছে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির কক্ষটি সুসজ্জিত করা হয়েছে এবং এ শ্রেণিকক্ষটি অধিকতর দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার ১ হাজার ৩৪৭টি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সজ্জিত করা হয়েছে শিশুর জন্য উপযোগী শিক্ষা-উপকরণ, পুস্তক, খেলনা ইত্যাদির মাধ্যমে এবং এই উদ্যোগ চলমান রয়েছে। শ্রেণিকক্ষ সুসজ্জিতকরণ, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগসহ অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সুসজ্জিতকরণের লক্ষ্যে প্রতিবছর বিদ্যালয়ে আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে। সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সুস্বাস্থ্যেই সুশিক্ষা। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে খুদে ডাক্তার কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি এবং উত্তম চর্চা সম্পর্কে নিয়মিতভাবে অবহিত করানো হচ্ছে। স্টুডেন্ট কাউন্সিল কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের বৃক্ষরোপণ ও বাগান তৈরি, পরিবেশ সংরক্ষণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন, পুস্তক ও শিখনসামগ্রী, পানিসম্পদ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলা হচ্ছে। বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে কর্মকর্তাগণ উক্ত বিষয়সমূহ মনিটর করে থাকেন।
বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির যুগ। শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং তাদের সঙ্গে আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ-সংস্কৃতির পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া এবং নিবিড়ভাবে চর্চার লক্ষ্যে প্রতি উপজেলার নির্ধারিত কিছু বিদ্যালয়ে হারমোনিয়াম, তবলা-ডুগি, পিয়ানো ও খেলাধুলার সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। এর দ্বারা শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে; অন্যদিকে তাদের মধ্যে নির্মল সংস্কৃতির চর্চা বাড়ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক আয়োজনসমূহে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুকে প্রাধান্যমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
Water-Sanitation ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছু বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক তৈরি করা হয়েছে। ছাত্র এবং ছাত্রীর জন্য পৃথক ওয়াশব্লক তৈরি করায় ছেলে ও মেয়েশিশু উভয়ের স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃব্যবস্থা ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে। এতে ছাত্রীর বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বেড়েছে।
লেখাপড়ার পাশাপশি খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক, মানসিক ও নান্দনিক বিকাশ, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সহিষ্ণুতা ও মনোবল বৃদ্ধিসহ তাদের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সুযোগ্য সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে প্রতি বছরই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইউনিয়ন/পৌরসভা, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও উন্মুক্ত বই পঠন অভ্যাস গড়ে তোলা ও বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীর মধ্যে জাগ্রত করার জন্য ১ হাজার ৪৬০টি বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার এবং মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার।
এ অবস্থায় আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষার মেলবন্ধন রচনা করার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আর এভাবেই শিক্ষার্থীরা সাদামনের মানুষ হয়ে, আলোকিত মানুষ হয়ে আগামী দিনের সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তারা বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের বই পড়বে, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখবে, সর্বোপরি আধুনিক, মুক্তমনা, পরার্থবাদী, কুসংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক, ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মত সহিষ্ণু হবে, তারা অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মনমানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে। তাদের মনোরাজ্যে অনেক তথ্যভান্ডার থাকবে। তারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সঠিক পথে দেশ গড়ার কাজ করবে। জীবজগত্, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি সহনশীল আচরণ করবে। সার্বিক পর্যালোচনায় বলাই যায় যে, বিগত একদশকে শিক্ষাব্যবস্থার আমুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে; কিন্তু এই অভিযানের এখানেই সমাপ্তি নয়। হাওরের প্রতিটি শিশু যে দিন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের গর্বিত অংশীদার হতে পারবে সে দিনের প্রতীক্ষায় উত্সর্গ আজকের শিক্ষায় সহায়তার এই ব্রত।
মোহাম্মদ আবদুল আহাদ : জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ।